
বিচারক ড. ইমান আলী শেখ।
‘আল্লাহ, ইশ্বর, ভগবান সবই কৃত্রিম’- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক লাইভে এমন মন্তব্যে ফেঁসে গেলেন শেরপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক (জেলা জজ) ড. ইমান আলী শেখ।
রবিবার এক প্রজ্ঞাপনে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে সম্ভাব্য অবস্থা আঁচ করতে পেরে শুক্রবার রাতেই তিনি বিশেষ নিরাপত্তায় শেরপুর ত্যাগ করেছেন।
অন্যদিকে ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে গুরুতর মন্তব্যের ওই ঘটনায় প্রতিবাদ-মানববন্ধন হওয়ার আগেই তিনি শেরপুর থেকে সটকে পড়লেও রবিবার বিষয়টি শেরপুরে ‘টক অব দি টাউন’ হিসেবে আলোচিত হয়।
তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অবস্থা বিবেচনায় তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হলেও বিষয়টি অনেকটা শাস্তিস্বরূপ। তদুপরি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতে পারে। এদিকে রবিবারই সুপ্রীম কোর্টের তরফ থেকে এক নির্দেশনায় বিচারকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সতর্কতা আরোপ করা হয়েছে।
জানা যায়, গত বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেরপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে যোগদান করেন ড. ইমান আলী শেখ। এরপরই বিচারক ও আইনজীবীদের মাঝে তার পরিচিতি ছড়ায় একজন ভাবুক, লেখক ও সাধক হিসেবে। নিজের লেখা গানও তিনি সুর করেন তার ‘গানে জ্ঞানে’ ইউটিউব চ্যানেলে। ওই অবস্থায় গত ১৪ এপ্রিল শুক্রবার বিচারক ড. ইমান আলী শেখ তার নিজ ফেসবুক আইডি থেকে লাইভে এসে বলেন, ‘কেউ বলেছেন তুর পর্বতে আল্লাহ আমার সাথে কথা বলেছেন।
কেউ বলেছেন হেরাগুহায় আল্লাহ ফেরেস্তার মাধ্যমে আমার কাছে বাণী পাঠিয়েছেন, কেউ বলেছেন, ঈশ্বর তার পবিত্র আত্মা দিয়ে আমাকে সৃষ্টি করেছেন, কেউ বলেছেন, আমিই স্বয়ং ভগবান, যুগে যুগে ধর্ম সংস্থাপন কল্পে আমি পৃথিবীতে আসি। এই আল্লাহ, ঈশ্বর বা ভগবান কৃত্তিম সর্বভৈব। এদের কেউই রিয়েল সর্বভৈব নয়।’
অন্যদিকে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে তার ওইরকম স্পর্শকাতর মন্তব্যে নিজ ফেসবুকে প্রতিবাদ জানান স্থানীয় তাহফিন হাসান তন্ময় নামে এক শিক্ষানবীশ আইনজীবী। এরপরই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। সেইসাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদও উঠতে থাকে।
স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের মাঝেও প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধনের প্রস্তুতি শুরু হয়। অবস্থা আঁচ করতে পেরে শেরপুরের বিচার বিভাগের তরফ থেকেই বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রীম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় অবহিত করা হয়। এরপর ওইদিন রাতেই তাকে বিশেষ নিরাপত্তায় শেরপুর থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়।
সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় রবিবার জারি হয় বদলির আদেশ। আইন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ ওসমান হায়দার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্য ইমান আলী শেখকে বদলি করে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হলো।
তাকে শেরপুরের জেলা ও দায়রা জজের নিকট বর্তমান পদের দায়িত্বভার দিয়ে অবিলম্বে নতুন কর্মস্থলে যোগদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো।
এদিকে ধর্ম অবমাননাকর ওই মন্তব্যের কারণে ড. ইমান আলী শেখকে তাৎক্ষণিক বদলি করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শেরপুরে কর্মরত আইনজীবীরা। স্বস্তি ফিরে এসেছে স্থানীয় বিচার বিভাগেও। আর ওই মন্তব্যের ঘটনায় প্রথম প্রতিবাদকারী যুবক তাহফিন হাসান তন্ময় সন্তোষ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মহান আল্লাহ অতি নগন্য আমার মতো মানুষের মাধ্যমে এই নাস্তিকের পতন ঘটাবে- এটাই হয়তো লিখা ছিল’।
ঘটনার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের পিপি এ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুলু বলেন, তিনি একজন ভাবুক ও ধ্যানী প্রকৃতির লেখক-গায়ক। ফেসবুক লাইভে তিনি খোদা, ইশ্বর, ভগবান সম্পর্কে বিভিন্নজনের মন্তব্যের মূল্যায়ন করেছেন। বিষয়টি খোদাভীরুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এজন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট এমকে মুরাদুজ্জামান বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ড. ইমান আলী শেখ তার ফেসবুক লাইভে নাস্তিকধর্মী কথাবার্তা বলায় স্থানীয়ভাবে পরিস্থিতি উত্যপ্ত হয়ে উঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। এজন্য বারের তরফ থেকে বিষয়টি জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ তৌফিক আজিজ এবং সিজেএম এসএম হুমায়ুন কবীরকে জানানো হলে তারা দ্রুত বিষয়টি আইন সচিব ও সুপ্রীম কোর্ট বিভাগে অবহিত করেন।
সে প্রেক্ষিতে তাকে প্রত্যাহার করায় স্থানীয়ভাবে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে তার অপসারণ দাবি জানান।
এমএস