ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরা-২

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা

প্রকাশিত: ০০:০১, ১৬ এপ্রিল ২০২৩

আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে একাধিক প্রার্থী

২০১৩ সালে জামায়াতের সহিংসতায় রক্তাক্ত সাতক্ষীরা-২

২০১৩ সালে জামায়াতের সহিংসতায় রক্তাক্ত সাতক্ষীরা-২ সদর আসনটি বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত ঘরানার  এই আসনটি এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দখলে। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নের এবং গত পাঁচ বছরের হিসাব নিকাশে  আওয়ামী লীগের অনেকেই এই আসনে নির্বাচন করে পুনরায় বিজয়ী হওয়ার দৃঢ় আশাবাদী। যদিও আসনটিতে আওয়ামী লীগ দুই ঘরানায় বিভক্ত। এ জন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় অনেক নেতা কর্মীর নাম শোনা যাচ্ছে। 
জাতীয় সংসদের ১০৬ (সাতক্ষীরা-২) নম্বর আসনটি সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ উপজেলায় বর্তমান ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে আসনটি সৃষ্ট হওয়ার পর আওয়ামী লীগ দুইবার, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি (এরশাদ)  একবার নির্বাচিত হলেও আসনটি মূলত জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত ছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে টানা তিন  মেয়াদে এ আসনটিতে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের শরিক দলের প্রার্থী জয়লাভ করলেও ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী জয়লাভ করে। 
চার দশকের ব্যবধানে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুইবার নির্বাচিত হলেও  ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এ জব্বার। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মনোনীত বীর মৃুক্তযোদ্ধা মীর মোসতাক আহমেদ রবি জয়লাভ করলেও জেলা ও মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের  মধ্যে সমন্বয়হীনতা থাকায় খুব একটা ইতিবাচক পরিস্থিতি  তৈরি করতে পারেনি আওয়ামী লীগ, এমন মতামত মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের।

এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশায় ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছেন দু’বারের নির্বাচিত এমপি মীর মোসতাক আহমেদ রবি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি আবারও দলীয় মনোনয়ন পাবেন এমন প্রত্যাশায় তিনি এখন মাঠে সক্রিয়। ইতোমধ্যে তিনি নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। একজন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সৈনিক হিসাবে তিনি আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচনের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছেন। 
নির্বাচনী এলাকায় দলীয় কোন্দলের অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোসতাক আহমেদ রবি জনকণ্ঠকে বলেন, মতবিরোধ আগে থাকলেও এখন নেই। দলের জেলা সম্পাদক নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়েই তিনি মাঠে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত ইমেজ রয়েছে তার এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বিএনপি-জামায়াত জোট হলে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হবে এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন, নেত্রী মনোনয়ন দিলে তিনি অবশ্যই বিজয়ী হবেন। 
এই আসনে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। কয়েকদফা সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও তিনি এবার  মনোনয়ন চাইবেন। জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে প্রথমবার জয়লাভ করার পর তিনি দ্বিতীয় দফায় পুনরায় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে নির্বাচনী এলাকায় তার ব্যক্তি ইমেজ খুব ভালো। 
তবে দলের মধ্যে বিরোধ  এখন অনেকটা কমে গেছে এমনটা জানিয়ে নজরুল ইসলাম জনকন্ঠকে বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার জন্য কাজ করবেন। ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে সদস্য সংগ্রহ ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজ চলছে। তিনি মনে করেন, জামায়াতের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত এই আসনে জামায়াত আগের মতো শক্তিশালী নেই। ধর্মের অনুভূতির রাজনীতিতে এখন সাধারণ মানুষ সাড়া দেয় না এমনটা মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক  দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনায়ন প্রত্যাশী নজরুল ইসলাম। 
বর্তমান সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের জেলা সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি সাতক্ষীরা সদর আসনে  মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে রয়েছেন তরুণ নেতা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান বাবু। বর্তমানসহ  তিনি পরপর দু’দফায় সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় তার দলীয় সমর্থক ও কর্মীরা উজ্জীবিত। ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় তিনি মাঠে কাজ করছেন। মাঠ পর্যায়ে তার সমর্থন ও ইমেজ রয়েছে এমনটা দাবি তার কর্মী সমর্থকদের। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় তিনি আশাবাদী। 
এই তরুণ নেতা মনে করেন, সিনিয়র অনেক নেতার আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে মাঠ পর্যায়ে দলের ইমেজ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর এত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরও মাঠ পর্যায়ে ভোটারদের মধ্যে দলের সাংগঠনিক ভিত গড়ে তুলতে পারেনি নেতৃবৃন্দ।   
একাধারে সাংবাদিক ও রাজনীতিক এবং শ্রমিক নেতা  আওয়ামী লীগের  জেলা কমিটির সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদ। তিনিও সাতক্ষীরা সদর আসনে আওয়ামী লীগের দলীয়  মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। সাবেক অধ্যক্ষ, শ্রমিকলীগ নেতা ও স্থানীয় একটি দৈনিকের সম্পাদক হিসাবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দলের জন্য কাজ করছেন। তিনি বলেন, তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। 
এ ছাড়া  বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক আহম তারেক উদ্দিন মনোনয়ন চাইবেন এমন প্রচার রয়েছে। তিনিও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন। এ ছাড়া ভোরের পাতা পত্রিকার সম্পাদক এরতেজা হাসান জজও সাতক্ষীরা সদর আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। সব মিলিয়ে জামায়াত ঘরানার  সাতক্ষীরা সদর আসনে  মাঠ পর্যায়ের বিভেদ ও বিভাজন দূর না হলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কঠিন চাপে পড়তে হতে পারে বলে মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীরা মনে করেন। 
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরার চারটি আসনে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো যখন তৎপর তখন ব্যতিক্রম অবস্থানে জাতীয় পার্টি। টানা দুই মেয়াদে জাতীয় পার্টি দেশের প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকলেও সেই অর্থে সাতক্ষীরার শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে জাতীয় পার্টি নিজেদের জায়গা ও কর্মী সমর্থকদের তৎপরতা তেমন চোখে পড়ে না বলে মতামত সাধারণ ভোটারদের। 
মহাজোটের প্রার্থী হয়ে সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে সদর আসনে জয় পায় জাতীয় পার্টি। এরপর অনুষ্ঠিত দুটি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির কোনপ্রার্থী এ আসন থেকে জয় পায়নি। বরং, কাক্সিক্ষত ভোট না পাওয়ায় এ আসনে জামানত হারাতে হয় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের।  তবে এই আসনে জাতীয় পার্টি একবার জয়লাভ করায় এই আসনে জাতীয় পার্টি জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শেখ আজহার হোসেন, জেলার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু, সদর  উপজেলা কমিটির সভাপতি আনোয়ার জাহিদ তপন  মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বলে জানান।  এই তিনজন দলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। 
মনোনয়ন প্রত্যাশী  জেলা জাপার সভাপতি শেখ আজাহার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয়পার্টি প্রথম জামায়াত ঘরানার এই আসনে জয়লাভ করে। আসন্ন নির্বাচনে তিনি ও দলের সেক্রেটারি সদর আসনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। জামায়াত ও বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে সেখানে জাতীয় পার্টির অবস্থান ভালো হবে বলে তিনি করেন।   
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তৎকালীন সময়ের সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সভাপতি ও ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট শামছুল হক। এরপর থেকে বিএনপির শরিক দলের প্রার্থী এ আসন থেকে জয়লাভ করলেও বিএনপির কোনো দলীয় প্রার্থী এ আসন থেকে জয়লাভ করতে পারেনি। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত, বিএনপির জোট থেকে সরে আসায় বর্তমানে এ আসনে  প্রার্থীর সংকটে ভুগছে দলটি।
এ আসনে সাংগঠনিকভাবে  বিএনপি দুর্বল অবস্থানে। এই আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায়  সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক আব্দুর রউফ, সদস্য সচিব আব্দুল আলীম, পৌর বিএনপির সদস্য সচিব তাসকীন আহমেদ চিশতির নাম শোনা  যাচ্ছে। তবে তারা কেউই এখনো সরাসরি মাঠে নামেনি। সদর আসনে  একবার জাতীয় পার্টি  জয়লাভ করায় জাতীয় পার্টি মনে করে বিএনপি নির্বাচন না করলে সেই ঘরানার অনেক ভোট তাদের ঘরে আসতে পারে । 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২টি আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। তবে সেবারের নির্বাচনে একটি আসনেও জয় পাইনি জামায়াত। 
এমন টানাপোড়েনের মধ্যে গতবছর বিএনপির জোট ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয়া হয় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে। ফলে প্রায় ২৪ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে জামায়াত-বিএনপির। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হওয়াতে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত আওয়ামী লীগ। নিবন্ধন হারানো এই সংগঠনটি বর্তমানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াত দল হিসেবে তাদের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে জামায়াতের নেতারা অন্য কোনো নিবন্ধিত দলের প্রতীকে বা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে পারবেন এই প্রত্যাশায় তারা এখন গোপনে মাঠে কাজ করছেন। 
এসবের ভেতরে দেশের ৩০০ আসনের ভেতরে ১২০টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াত। যে তালিকার ভেতরে রয়েছে সাতক্ষীরার চারটি আসনের ভেতরে তিনটি আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থীর নাম। একটি আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা না করলেও গোপনে জেলার চারটি আসনেই নিজেদের নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা।

×