
টিনের চকচকে ঘর
সারিবদ্ধভাবে লাল রঙিন টিনের চকচকে ঘর। ঘরগুলোর সামনে ছোট্ট বাগান। বাগানে চাষ করা হচ্ছে বেগুন, পেয়ারা, আমলকী, পেঁপে, কলা ও শাকসবজি। যা নিজেরা খেয়ে বিক্রিও করছেন ঘরগুলোর বাসিন্দারা। আবার কেউ কেউ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি লালন-পালন করছেন। এসব বিক্রি করেও অনেকটাই স্বাবলম্বী তারা। বলছি বাগেরহাটের ৯ উপজেলার ভূমিহীন ও গৃহহীন ১ হাজার ৬৩৭ পরিবারের কথা। যারা প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দেয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন।
এক সময় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, উন্নত জীবনযাপন ছিল তাদের কাছে পাহাড়সম স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া জমিসহ পাকা ঘর পেয়ে এখন বদলে গেছে তাদের জীবন-জীবিকার গল্প। এ সকল গৃহহীনকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনেও অবদান রেখেছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। ভূমিসহ শুধু ঘরই নয়; চাষাবাদের জন্য বিভিন্ন গাছের চারা, বীজ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করেছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এসব বিষয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণও। ফলে ভাগ্য বদলেছে ঘর পাওয়া পরিবারগুলোর।
বুধবার কয়েকটি উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। ঘরগুলোতে বসবাসরত মানুষগুলোর চোখেমুখে এখন আনন্দের ছাপ। কেননা, মাত্র কয়েক মাস আগেও তারা ছিলেন গৃহহীন ও ভূমিহীন। এখন নিজ ঘরে থেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন তারা। উপহার পাওয়া ঘর মনের মতো করে সাজাচ্ছেন। সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার প্রত্যয় নিয়ে এগোচ্ছেন।
রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা ইউনিয়ের ‘গৌরম্ভা আশ্রয়ণে’ গিয়ে দেখা যায়, ঘর পাওয়া বাসিন্দারা ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। পরস্পরে মিলেমিশে বসবাস করছেন।
এই আশ্রয়ণের বাসিন্দা হনুফা বেগম (৩৫)। কিশোরী বয়সে বিয়ে হওয়া হনুফার স্বামী ফরহাদ শেখের সঙ্গে ১০ বছর আগে বিচ্ছেদ হয়। ৩ সন্তানকে নিয়ে কখনও নদীর চরে, কখনও ব্রিজের ঢালে, রাস্তার পাশে, কখনও বা অন্যের আশ্রয়ে থেকেছেন তিনি। নিজের বাবা-মাও পরিচয় দিতেন না হনুফাকে। সব কষ্ট বুকে জমিয়ে নারী হয়েও পুরুষদের মতোই খেত-খামারে কাজ করেছেন সন্তানদের মানুষ করার জন্য। স্বল্প আয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে সংসারের চাকা ঘুরিয়ে কখনও নিজে বাড়ির মালিক হবেন, সেটি স্বপ্নেও ভাবেননি। সেখানে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা তো কল্পনাই ছিল না। তবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হনুফার জীবন চাকা। এখন নিজেই লালনপালন করছেন গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি। চাষ করছেন শাকসবজি। এসব বিক্রি করে আলমারি, শোকেজ, রাইস কুকারও কিনেছেন। অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা হনুফার স্বপ্নের রাজমহলে এখন সুখের বন্যা বইছে।
হনুফা বেগমের ৩ ঘর পরের বাসিন্দা আল-আমিন (৩৬)। তিনিও আলোকদিয়া চরে থাকতেন। সেখানে খাল খননের সময় উচ্ছেদের পর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। পরে আশ্রয়ণের ঘর পান তিনিও।
আল-আমিনের মনের দুঃখ, কিশোর বয়স থেকে কাঠমিস্ত্রির কাজ করে অন্যের ঘর গড়ে দিলেও নিজের জন্য ঘর করার সামর্থ্য হয়নি। এখন আশ্রয়ণের ঘর পেয়ে মনের মতো করে সাজাচ্ছেন। দুই ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছেন।
বাগেরহাটের কচুয়া, চিতলমারী, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলায় নির্মিত ঘরগুলোতে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। তারাও বিভিন্নভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
জানতে চাইলে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ আজিজুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, বাগেরহাটে ৪ হাজার ৯৬৩ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন রয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৩৭টি পরিবারকে এরইমধ্যে জমিসহ ঘর উপহার দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার আরও ৫০০টি পরিবারের মাঝে নতুন ঘর তুলে দেয়া হবে। এ উপলক্ষে ঘরগুলোর কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে এবং সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ডিসি বলেন, ইতোমধ্যে যারা ঘর পেয়েছেন তারা দিনমজুর, গৃহকর্মী, ভ্যানচালক, ভিক্ষুকসহ নিম্ন আয়ের মানুষ। এমন জায়গায় ঘরগুলো করা হয়েছে, যাতে তারা সহজে জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পারে। তাদের অনেকে এখন চিংড়ি ঘেরে কাজ করেন। জীবিকা নির্বাহে তাদের চাষাবাদের ব্যবস্থা করা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাষাবাদ করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ফলে তারা এখন চাষাবাদ করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাদক, কিশোর গ্যাং রোধে মোটিভেট করা হয়েছে। আমরা প্রায়শই ওই সকল গুচ্ছগ্রাম পরিদর্শনে যাই এবং মনিটরিং করে থাকি। ঘর পাওয়া মানুষগুলো এখন এতটাই খুশি যে, তারা প্রধানমন্ত্রীকে দোয়া করেন।
ঘর পাচ্ছেন আলোর পথে ফেরা জলদস্যুরাও ॥ ভূমিহীন গৃহহীন মানুষদের মতোই আলোর পথে ফেরা ঠিকানাহীন জলদস্যুদেরও নতুন ঘর দিচ্ছে সরকার। তেমনি একজন আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, বাবার চিকিৎসা খরচ জোগাতে মাছ ধরে উপার্জন করতে গিয়ে জলদস্যুতায় জড়িয়ে পড়ি। দীর্ঘ ১৪ বছর অন্ধকার পথে চলার পর আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছি। নিজের ঘরবাড়ি, জমি কিছুই ছিল না। সরকার শ্রীফলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর দিতে যাচ্ছে। দোয়া করবেন, পরিবার নিয়ে যেন ভাল থাকতে পারি। ঘর উপহার দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন হান্নান।
আবদুল হান্নানের সঙ্গে বাগেরহাটের শ্রীফলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় ঘর পাচ্ছেন জিয়াউর রহমানও।
আজ ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী ॥ আজ বৃহস্পতিবার ৫২ উপজেলায় ২৬ হাজার ২২৯টি ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভার্চুয়াল যুক্ত হয়ে তৃতীয় পর্যায়ের ২য় ধাপের ঘরগুলো হস্তান্তর করা হবে। এ উপলক্ষে ৫ জেলার কয়েকটি স্থান থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত থাকবেন জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টরা।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, এর আগে তিন দফায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৯টি ঘর পেয়েছেন গৃহহীনরা। এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ২৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।