ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

পুরান ঢাকার জীবন ও সংস্কৃতি ঐশ্বর্যের বাতিঘর

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ১৪ মে ২০২২

পুরান ঢাকার জীবন ও সংস্কৃতি ঐশ্বর্যের বাতিঘর

সমুদ্র হক ॥ আজকের ঢাকা যান্ত্রিক এক মহানগরী। সেই দিনের ঢাকার (যার পরিচিতি পুরান ঢাকা) জীবন সংস্কৃতি ঐশ্বর্যের বাতিঘর হয়ে আছে। সেই আলোয় আলোকিত রাজধানী ঢাকা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে (অনেক প্রবীণের কাছেও) যা অজানা। মানুষ বাড়িঘর যানবাহনে ঢাকা এক অস্থির নগরী। বায়ুদূষণ শব্দদূষণ যানজটে ঢাকা এগিয়ে চলেছে। গবেষকরা বলছেন প্রকৃত ঢাকাবাসীর (পুরান ঢাকা) সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতের দিল্লীর স্থানীয়দের সংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পুরান দিল্লীর মানুষের কালচার পুরান ঢাকার মতোই। সুবে বাংলার প্রথম শাসক সুবেদার ইসলাম খান প্রায় চারশ’ বছর আগে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে বুড়িগঙ্গার তীরে আনন্দকে ধরে রাখার বহির্প্রকাশে ঢাক বাজাবার নির্দেশ দেন। জনশ্রুতি আছে ঢাকির বাদ্যের তালে সুবে বাংলার (তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড,ওড়িশার কিছু অংশ) রাজধানীর নাম হলো ‘ঢাকা’। একই সঙ্গে বহু ভাষার মিশ্রণের সংস্কৃতির ধারায় (যার মধ্যে বেশি আধিক্য বাংলা, ফার্সী,আরবী, হিন্দী,উর্দুু) অধিক পরিচিতি পায় ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা নামে। ভাষার বৈচিত্র্যে আদি ঢাকাবাসী (বলা হয় প্রকৃত ঢাকাবাসী) পরিচিতি পায় কুট্টি নামে। কেউ বলেন ঢাকাইয়া। এই নামে তারা অবশ্য গর্ববোধ করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঢাকা কিছুটা সময়ের জন্য নামকরণ হয় জাহাঙ্গীরনগর। মুঘল চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নামটি কোন স্থাপনা ও উচ্চতর বিদ্যাপীঠের নামকরণ হয়। ঢাকার ইংরেজী বানান বহুকাল ছিল ডিএসিসিএ। গত শতকের ৮০’র দশকে ইংরেজী বানান হয় ডিএইচএকেএ। ঢাকা সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় তাল মেলাতে শুরু করে বহুকাল আগেই। যার আঁতুড়ঘর আজকের পুরান ঢাকা। সম্প্রসারিত হতে থাকে চারদিকে। দেশের প্রতিটি স্থানের মানুষ পা ফেলতে শুরু করে ঢাকার দিকে। কেউ বসতি গড়ে। বহু ভাষার মিশ্রণে তৈরি হওয়া ভাষার মতো বিভিন্ন জেলার মানুষের ঢাকা আগমনে ঢাকা মহানগরী হয়ে সার্বজনীন মানুষের ভূমিতে পরিণত হয়। বুড়িগঙ্গার তীরে দক্ষিণের এলাকাটি আজকের পুরান ঢাকা। ভাষা ও সংস্কৃতি রূপাতীত হয়ে ধরে রেখেছে ঐতিহ্য। বহু পুরাকীর্তি, ইতিহাসের স্থাপত্য নিদর্শন পুরান ঢাকাকে করেছে মহিমান্বিত। ভাষার বৈচিত্র্যেই পুরান ঢাকার মানুষের অতিথি আপ্যায়ন, ভোজন বিলাস, অমায়িক ব্যবহার, বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি অপার শ্রদ্ধা নিবিড় বন্ধনে নিয়ে আসে। তাদের বুদ্ধিমত্তা জীবন চলার পথের আনন্দ দেয়। কুট্টি ভাষায় ‘সেন্স অব হিউমারে’ আনন্দের বহির্প্রকাশ ঘটায়। তাদের কমন কথা ‘আবে হালা’ শুনে কেউ কষ্ট পেতে পারে। তবে এটাই ঢাকাইয়া ভাষার বৈচিত্র্যের আন্তরিকতা। চ ও ছ বর্ণের মিশ্রণের কথা, কোন বর্ণে জোরে চাপ দিয়ে কথা বলা আকর্ষণীয়। সেদিনের পুরান ঢাকার স্মৃতি কথা বলার লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্তমানের প্রবীণগণ যা বলেন তা পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শোনা। চকবাজারের একজন বললেন ‘বাবজানে কইছ্যে রেসকোর্সে ঘোড় দৌড় হইতো। হালায় সূর্য ভি ওঠবার দেয়নাই ক্য। সাহেব সুবারা যাইয়া তাগড়া জুয়ান ঘোড়া দেইখ্যা থাবা দিয়া কইতো এইডা ঠিক কর! ঘোড়ার পিঠে জরির কাপড় বইয়া রাজা বানাইয়া দিত। হেই ঘোড়া দৌড়াইয়া এক নম্বর হইলে বাজি জিইত্যা যাইতো।’ সেদিনের রেসকোর্স ময়দান আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বংশাল রোডের নিজামউদ্দিন বললেন ‘আমাগর এইহ্যানে কী যে কাওয়ালি হইতো বুঝাইবার পারুম ন্যা। সামিয়ানা টাইঙ্গা স্টেজ ভি বানাইয়া হারমোনিয়াম তবলা লইয়া বইতো কাওয়ালরা। কম্পিটিশন করতো। এক কাওয়াল আরেক কাওয়ালরে কাইত কইরা ফ্যেলাইতো। বহুত নামকরা কাওয়াল আছিল। আমাগর এইহ্যানে বহুত কিছু আছিল। মনের মইধ্যে বহুত সুখ শান্তি ভি আছিল। মগর অহন সুখও নাই শান্তিও নাই ক্যা।’ কেন নেই এমনটি জানতে চাইলে বলেন ‘আবে হালায় থাকবো ক্যামতে। দ্যখবার পারতাছেন না। যে দিন যায়গা উ দিন আর আহে নাইক্যা।’ পুরান ঢাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বললে তারা সংস্কৃতির বর্ণনা তুলে ধরেন। পুরান ঢাকা ছিল সাহিত্য সংস্কৃতি বিনোদন ঐশ^র্যে পরিপূর্ণ এক সমৃদ্ধ জনপদ। লাঠিখেলা, পালা গান, জারি গান, খোল, কনক, সানাই, বাঁশি বাজিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। প্রায় সন্ধ্যায় বিভিন্ন উঠানের অনুষ্ঠানে বাড়ির বৌঝিয়েরা ঘোমটার আড়ালে গান শুনতো। যাত্রা ও নাটকের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার নামডাক ছিল। বিলুপ্ত শাবিস্তান সিনেমার পাশে আর্মেনিয়াম গির্জার সামনে ছিল একটি নাট্যমঞ্চ। পুরান ঢাকার নাটকের খ্যাতি ছিল। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত লালকুঠি থিয়েটার মঞ্চ ছিল বিখ্যাত নাট্যকেন্দ্র। শৌখিন ব্যক্তিগণ তরুণদের নাটক করতে উৎসাহ দিতেন। এই মঞ্চেই অনেক নাট্যশিল্পী ও সিনেমা অভিনেতার হাতেখড়ি। সেদিনের উদ্যমী তরুণরা নাটক ও যাত্রা দুই মাধ্যমকেই শক্তিশালী করে। পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক যানবাহন ঘোড়াগাড়ি। দুই ঘোড়া ও চার ঘোড়ায় চালিত রাজকীয় ঘোড়াগাড়ি ঐশ্বর্য ধরে রেখেছে। বিদেশী মেহমান এলে টিকে থাকা হাতে গোনা ঘোড়াগাড়ি বের করা হয় রাজপথে। পুরান ঢাকা থেকেই খেলাধূলার সূত্রপাত ঘটে। আরমানিটোলার কয়েকটি যুব সংগঠন ফুটবল দল গড়ে তোলে। তারা সামাজিক ও সেবামূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ে। সকল ধর্মের মানুষের মিলন কেন্দ্র ছিল পুরান ঢাকা। সম্প্রীতির বন্ধনে মুসলমানের ঈদ উৎসব, শিয়া মুসলমানদের মহরমের তাজিয়া উৎসব, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূজা পার্বণ, খ্রীস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উৎসব ছাড়াও পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসব, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষবরণ সহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকতো ভরবছর। খাওয়ার আয়োজনে মোরগ পোলাও, বিরিয়াানি, কয়েক ধরনের কাবাব, বাখরখানি, ফালুদাসহ বাহারি কত যে খাবার তৈরি হয় পুরান ঢাকায়। পুরান ঢাকার সামাজিক বন্ধন ও বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে যে ধুমধাম হয় তা বিরল। তারা পুত্রবধূ ও জামাইকে খুবই সম্মান দেয়। বাহাদুর শাহ পার্ক স্থাপিত হয়েছিল সকল মানুষের সবুজের আচ্ছাদনে ঘুরে বেড়ানো বিনোদন ভূমিতে। শাঁখারিবাজার ছিল সঙ্গীতের যন্ত্রপাতির তৈরির এলাকা। যেখানে গহনা তৈরিও হতো। বাংলাবাজার সর্ববৃহৎ পুস্তক বিপণিবাজার। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী সকল ধরনের বইয়ের প্রকাশ ও পরিবেশনা কেন্দ্র। বড় লাইব্রেরি, ছাপাখানা ঘিরে এই এলাকা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখক বুদ্ধিজীবী, ভিড় জমায় বাংলাবাজারে। কাছেই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও সংলগ্ন হাসপাতাল (মিটফোর্ড) গড়ে তোলা হয়। সদরঘাট (ঢাকার বড় নৌঘাট), লালবাগের কেল্লা, তারা মসজিদ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, আহসান মঞ্জিল, হোসেনী দালান, বড় ও ছোট কাটরাসহ ৮ টি থানা নিয়ে গঠিত পুরান ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বড় পরিচিতি। আধুনিক সংস্কৃতির উন্নত ছোঁয়া বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে পুরান ঢাকার সংস্কৃতিকে। প্রাচীন অনুষ্ঠানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। পুরাতন ঢাকার ছেলেমেয়েদের একটি অংশ এখনও পূর্বসূরির ধ্যান-ধারণায় লালিত। অনেক ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে শিক্ষায় ইতি দিয়ে নামে কর্মজীবনে। যাদের পরিবার ব্যবসায়ী ভাবাপন্ন। অভিভাবকরাও লেখাপড়া ও সৃজনশীলতার চেয়ে কর্মদক্ষতায় বেশি গুরুত্ব দেয়। তারপরও উত্তরসূরির একটি অংশ এই অচলায়তন ভেঙ্গে দিচ্ছে। আধুনিক সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে এদের অনেকে উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে। নারীদেরও একটি অংশ উচ্চশিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, প্রকৌশলী সিভিল সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা হয়েছেন। পুরান ঢাকার ঐশ্বর্য্যরে বাতিঘর বাংলাবাজর। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির বইমেলার বই প্রকাশের একমাত্র কেন্দ্র এই বাংলাবাজার। যেখানে লেখক বুদ্ধিজীবীদের পদচারণায় মুখর থাকে ভরবছর।
×