ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবন-জীবিকা

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জীবন-জীবিকা

রাস্তা কুড়ানি পথশিশু বাড়িতে বর্জ্য ও আবর্জনা মনে করে ফেলে দেয়া হয়। আইসক্রিম খেয়ে প্লাস্টিকের কৌটা, মিনারেল ওয়াটার, ঠান্ডা পানীয় পান করার পর বোতল ছুড়ে ফেলা হয়। ছেঁড়া স্পঞ্জ, স্যান্ডেল, নষ্ট জুতা, ফিউজড বাল্ব, ভাংড়িসহ নানা জিনিস ফেলে দেয়া হয়। এই সবের কিছু বাসাবাড়িতে ঘুরে কিনে নিয়ে যায় ভাংড়ি মালামালের হকাররা। কিছু রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে পলি বস্তায় ভরায় পথশিশুরা। এরা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরে বেড়ায়। রাস্তার দুই ধারে ওদের চোখ থাকে একেবারে বকের মতো। কোন কিছুই চোখ এড়ায় না। ফেলে দেয়া সামান্য কাগজের বড় টুকরো, ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকানের পোড়ানো খড়ির টুকরো, ভাঙ্গা কাচের টুকরা ... ফেলে দেয়া হেন কোন জিনিস নেই যা তারা কুড়ায় না। দিনভর এসব কুড়িয়ে এনে কোন্টি কোন্ দোকানে দেবে তা বেছে নিয়ে আলাদা করে। তারপর বিকেল শেষে নগরীর ভাংড়ির দোকানগুলোতে গিয়ে এসব জিনিস দিয়ে যা পায় তাই নিয়ে ফেরে বস্তিতে। এরা বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে নগরীর বিভিন্ন স্থানে। রেলওয়ে স্টেশনের আশপাশেই থাকে বেশি। এদের নাওয়া খাওয়ার কোন সময় নেই। রাস্তার ধারে কোন টিউবওয়েলে, ট্যাপকলে কখনও পুকুড়ে এরা দল বেঁধে গিয়ে জলকেলি খেলে গোসল সাড়ে মহাআনন্দের সঙ্গে। এরা কখন কি খায় তা ভাবলে অবাক হতে হয়। যারা অতি চালাক কোন বড় হোটেলের সামনে ওঁৎ পেতে থাকে। এদের মনস্তত্ত্ব¡ জ্ঞান প্রখর। হোটেলে যারা আহারের জন্য প্রবেশ করে তাদের চোখ মুখের ভাবভঙ্গি দেখে এরা পিছু নেয়। এক পর্যায়ে মায়াবি করুণ চাহনী দিয়ে কিছু খেতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা সফল হয়। এ ছাড়াও দিনভর রাস্তা কুড়িয়ে ভাংড়ি দোকানিদের কাছে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে পছন্দের খাবার কিনে নেয়। নগরীর মার্কেটের অনেক দোকানি ও হোটেল কর্তৃপক্ষের ফুট ফরমায়েশ খেটে সখ্যতা গড়ে তোলে। তারাও এদের হাতে বখশিশ দেয়। এই বখশিশে এরা খাবার সংগ্রহ করে। এরা রাতে ঘুমায় রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে, কোন স্কুলের বারান্দায় ও বস্তিতে। যারা বস্তিতে থাকে তারা উপার্জিত অংশের কিছুটা পরিবারে দেয়। তবে এই সংখ্যা খুব কম। এরা দিনভর বস্তা নিয়ে ঘোরাঘুরি করার পর সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই এরা হৈচৈ করে আনন্দ করে। এটাই তাদের বিনোদন। পথশিশু রুস্তম বলল ‘এ্যাগলে শূন্যে কি করবেন। হামাগেরক কাম করব্যর দ্যান।’ সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে ব্লাড প্রেশার মাপেন ফরিদ ফরিদ আহমেদ- জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টারত এক হতদরিদ্র মানুষ। সহায়-সম্বল না থাকায় আর্থিক অনটনে সংসারের দৈন্যদশার পরও তিনি কারও কাছে হাত পাততে অভ্যস্ত নন। যে কারণে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মানুষের ব্লাড প্রেশার মাপার মতো এক অভিনব পেশা বেছে নিয়ে জীবন সংসারের চাকা ঘোরানোর চেষ্টায় নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। কিন্তু তাতেও ওষ্ঠাগত তার জীবন। কথা হয় শেরপুরের নকলা উপজেলার বানের্শ্বদী গ্রামের ভূমিহীন হতদরিদ্র পরিবারের এক সদস্য ফরিদ আহমেদের সঙ্গে। কথোপকথনে জানা যায়, ১৯৮৮ সালে এসএসসি পাস করা ফরিদ পরবর্তীতে কলেজে ভর্তি হয়েও অর্থের অভাবে আর পড়ালেখা করা তার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওই অবস্থায় ফরিদ তার পিতা ইসরাফিল মিয়া ও মাতা সফুরা খাতুনের মৃত্যুর পর অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েন। ফলে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এলাকায় বাড়ি বাড়ি ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে বেকার জীবন অতিবাহিত করার এক পর্যায়ে ১৯৯৬ সালের দিকে স্থানীয় নাসরিন বেগমকে বিয়ে করে তাদের সংসারেই চলে যান। কিছুদিন পর শ্বশুর বদিউজ্জামানেরও মৃত্যু হলে তার সংসারে যোগ হয় শাশুড়ি আঞ্জুমান আরা। অন্যদিকে তাদের দাম্পত্য জীবনে জন্ম নেয় ২ ছেলে নাজমুল ও লোকমান। ২ সন্তানের জন্মের পর থেকে ৫ সদস্যের সংসার চালাতে একেবারেই কঠিন অবস্থায় নিপতিত হন ফরিদ। যে কারণে রাতে টিউশনির পাশাপাশি মাঝে মধ্যে এলাকাতেই দিনমজুরির কাজ করতেও বাধ্য হয়েছেন। এক পর্যায়ে তিনি সংসারের চাকা ঘুরাতে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে একটি এনজিও থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর ওই এনজিওর দেয়া একটি ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে তিনি জেলা-উপজেলা শহরের বিভিন্ন জায়গাসহ অফিস-আদালত, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, বাসা-বাড়িতে হেঁটে হেঁটে জনপ্রতি ৫-১০ টাকা নিয়ে মানুষের ব্লাড প্রেশার মাপার পেশায় জড়িয়ে পড়েন। কোন কোন সময় মানবিক কারণে কাউকে বিনা পয়সায় প্রেশারও মেপে দেন তিনি। আর ওই কাজ করে ফরিদ দৈনিক এক সময় ২-৩শ’ টাকা পেলেও এখন আর সেটাও জোটে না। তিনি শারীরিক অনেক সমস্যা নিয়েও জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ওই পেশায় থাকলেও এখন চরম ওষ্ঠাগত তার জীবন। ভ্রাম্যমাণ ব্লাড প্রেশার মেপেও মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে পরিবারের লোকজনসহ তাকে। ফরিদ আহমেদের ভবিষ্যত ইচ্ছা তিনি এক বছর মেয়াদি পল্লী চিকিৎসক ট্রেনিং করার। আর সেটা সম্ভব হলে তিনি একজন পল্লী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে সেটাও তার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তবে কোন প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকসহ সংশ্লিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানে তার একটি চাকরি হলে সেই উপার্জিত অর্থ দ্বারা বাকি জীবনটা সংসারের চাকা টেনে যাওয়া সম্ভব হত তার। এ জন্য প্রয়োজন মানবিক সহায়তা। নিরন্তর জীবনযুদ্ধে থাকা হতদরিদ্র ফরিদের প্রতি সমাজের সহৃদয়বান ও দানশীল ব্যক্তি বা আমাদের কেউ কি পারি না সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দিতে? রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর থেকে ঝাড়ু বিক্রেতা খলিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের সুরিয়াব এলাকার বৃদ্ধ খলিল (৬২)‘র ঝাড়ু তৈরি ও ফেরি করে বিক্রির দৃশ্য স্থানীয়দের কাঁদায়। বৃদ্ধ বয়সেও বোঝা মাথায় নিজেই ঝাড়ু তৈরি করে গ্রামের মেটোপথ বেয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ফেরি করে বিক্রি করে জীবন- জীবিকার হাল ধরে আছেন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে। তবু সংসারের অভাব অনটন পিছু ছাড়ছে না। নিজের এক শতক এক খ- জমির ওপর দু’চালা টিনের ঘর ছাড়া সহায় সম্বল বলতে কিছুই নেই। নিজের একমাত্র ছেলেটিও ভাল জীবিকার সন্ধান পায়নি তাই দিনমজুর হিসেবে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে সংসারে সহযোগিতা করত বলে জানা যায়। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলে কাজের কথা বলে ঢাকায় পারি জমায়। সেখানেই ছেলেটি তার স্ত্রীকে নিয়ে কোনমতে সংসার চালাতে গিয়ে পিতা-মাতাকে আশানুরূপ খরচ দিতে পারেনি। তাই পিতা খলিল বাধ্য হয়ে নিজের আহার নিজেকেই এখনও বোঝা মাথায় সংগ্রহ করতে হয়। বয়স ভারে নুয়ে পড়লেও জীবিকার তাগিদে এখনও কঠিন কাজটি করা ছাড়া তার যেন গতি নেই। ষাটোর্ধ বৃদ্ধ খলিল জানান, এক সময় আইসক্রিম বিক্রি করে চালাতেন সংসার। সে সময়ে তার ছেলেকে দিনমজুরের কাজ করে সংসারে সহযোগিতা করত। পরে তাকে বিয়ে করিয়ে দেয়ার পর ঢাকার কোন এক স্থানে জীবিকার তাগিদে চলে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি তার সংসারই চলে না। তাই আমাকে এখনও এ কাজ করতে হয়। আমার শরীরে বয়সে নানা রোগ-বালাই বাসা বেঁধেছে। শ্বাসকষ্ট ও শরীরের বাত ব্যথায় আক্রান্ত তিনি। এ ছাড়াও তার স্ত্রী হাজেরাও হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। এতে তার প্রতিদিন শতাধিক টাকার ওষুধ খেতে হয়। এ ছাড়া বাড়ির খাবার দাবার এ ঝাড়ু বিক্রির টাকা থেকেই যোগাড় করতে হয়। এ সময় তিনি আরও জানান, তার বয়স ৬২ হলেও একাধিকবার স্থানীয় মেম্বারের কাছে গিয়েও পাননি বয়স্ক ভাতা। তাকে পরে দেখা করার কথা বলে হয়রানি করে যাচ্ছে ইউপি সদস্য মজিবুর রহমান লিটন। তার দাবি এক সময় স্থানীয় টেক টিলায় অবাধে গড়ে ওঠা ছনচালা থেকে বিনামূল্যে ছন কেটে নিয়ে শুধু কায়িক শ্রম বিনিয়োগ করে ঝাড়ু তৈরি করতেন। এখন এসব ছন দূর জেলার পাইকারদের কাছ থেকে কিনে আনতে হয়। তাই এখন ঝাড়ু বিক্রি করেও আশানুরূপ টাকা পান না তিনি। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মীর আব্দুল আলীম রূপগঞ্জ, (নারায়ণগঞ্জ) থেকে ফুল বিক্রেতা জহুরুল ফুল সৌন্দর্যের প্রতীক। ফুলকে কেনা ভালবাসে? সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ বাড়ির আঙ্গিনায় ফুল চাষ করেন। কেউ বা আবার মৌসুমি ফুলের টব রাখেন বাড়ির ছাদ বা ঘরের বারান্দায়। আর শিশুদের খেলনা কিংবা ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ঘরে রাখেন কৃত্রিম ফুল। তাছাড়া বিয়ে, জন্মদিন, শুভ হালখাতাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাগজের ফুলের কদর তো রয়েছেই। তাই প্রতিদিন আত্রাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের হাট-বাজার, পাড়া-মহল্লার পথে পথে ঘুরে ঘুরে রঙিন কাগজের ফুল ও প্লাস্টিকের ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আত্রাই উপজেলার জামগ্রামের সাজ্জাদ প্রামাণিকের কিশোর পুত্র জহুরুল ইসলাম। সারাদিন কাঠফাটা রোদ কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি যাই হোক না কেন ব্যবসা করতে যেতেই হবে তাকে। ফুল বিক্রি করতেই হবে। তা না হলে সংসার চলবে কি করে? নিজ হাতে তৈরি কাগজের ফুলই তো তার অন্ন যোগাতে সিংহভাগ ভূমিকা রাখছে। ফুল নেবে... ফুল...লাল-নীল রঙিন কাগজের ফুল। এমন করে গ্রামের মেঠোপথে কাগজের ফুল বিক্রেতার হাঁক শুনলেই গ্রামের ছোট-বড় সবাই ছুটে আসেন ফুল কিনতে। কাগজের ফুল শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, আত্রাইয়ের অর্ধশত পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে বিশেষ ভূমিকাও পালন করছে। আত্রাই উপজেলার জামগ্রাম ঘুরে দেখলে মনে হয়, যেন ফুলের মেলা বসেছে। আর কাগজের ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে উপজেলার জামগ্রামের জহুরুল ইসলামসহ অর্ধশত পরিবার। বৃহস্পতিবার নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ভবানীপুর জমিদার বাড়ির সামনে পড়ন্ত বিকেলে দেখা মিলল জহুরুল ইসলাম নামে এই কাগজের ফুল বিক্রেতার সঙ্গে। ফুল বিক্রির পাশাপাশি দীর্ঘ সময় আলাপচারিতায় তিনি বলেন, আমি আগে বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। জীবিকা অর্জন আর অল্প পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায় বলেই আজ আমি এ ব্যবসা শুরু করেছি। বাবা-মা ভাইকে সঙ্গে নিয়েই অভাবের সংসারে এভাবেই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন সকাল হলেই ফুল বিক্রি করতে চলে যাই উপজেলার ভবানীপুর, কাশিয়াবাড়ি, নওদুলি, বান্ধাইখাড়া, সিংসাড়া, ধর্মপুর, লালপাড়া, বিষা ও হাটকালুপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে। প্রতিদিন আমি কম পক্ষে ২৫০ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি। তিনি আরও বলেন, ব্যবসা যদিও লাভজনক তার পরও জীবনের যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে আমাদের এ ব্যবসা করতে হয়। আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের ছাদে বা ট্রাকে গন্তব্যে যেতে হয়। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×