ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রূপায়ণ ভট্টাচার্য, ক্রীড়া সম্পাদক এই সময়

মননে বাঙালী, ভাবনায় আন্তর্জাতিক এক সন্ধ্যাতারা

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৫ মার্চ ২০২০

মননে বাঙালী, ভাবনায় আন্তর্জাতিক এক সন্ধ্যাতারা

রবিশঙ্করকে আপনি একবার বলেছিলেন, ‘ইমন দিয়ে সবাই গান শিখতে শুরু করে। আমিও তাই করেছিলাম।’ রাত্রির প্রথম প্রহরে ইমন গাওয়ার সময়। গত সন্ধ্যায় সে সময়ই আপনাকে শেষবারের জন্য দেখলাম প্রদীপদা। আকাশে যে সন্ধ্যাতারা জ্বলছিল চাঁদের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে, আমার কাছে সেটা আপনিই। ইমন রাগের সমস্ত গান তোলা রইল আপনারই জন্য। মননে বাঙালী, ভাবনায় আন্তর্জাতিক এক সন্ধ্যাতারা পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়...। শুধু এই আলোকময় নামটা লিখে বসে থাকি দীর্ঘ সময়। আর কোন শব্দ লিখতে পারি না। লেখার ইচ্ছে হয় না। আর কিচ্ছু মনে পড়ে না। দীর্ঘ সময় পরে আস্তে আস্তে মনে পড়তে থাকে সব। ফেয়ারলি প্লেসে রেলের অফিসে শেষ প্রান্তে কোণের দিকে তার বিশাল ঘর। চেয়ারের ওপর সাদা তোয়ালে পাতা। ঘরটা, তোয়ালে ঢাকা চেয়ারটা, রেলের চাকরিটা নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব ছিল তার। আর মনে পড়ে তার নানা রঙের চকচকে জামাগুলো, গোল রোদচশমা। মুখে মিটি মিটি হাসি, মাঝে কেশহীন কপালে হাত বুলিয়ে নেয়া। অসামান্য আন্তরিকতা এবং রসিকতামাখা সংলাপ। প্রাণের ময়দানে, তিন বড় ক্লাবে আর শেষবারের জন্য যাওয়া হলো না পিকের, ভেবে আরও কষ্ট। এখনও সেখানে পাশ দিয়ে ট্রাম যেতে দেখলে স্মৃতির অথৈ সমুদ্রের ঢেউ ঝাঁকিয়ে যায়। এই রেড রোড দিয়েই যে সকালে তার স্টার শিষ্যদের নিয়ে ট্রামের সঙ্গে পিকে পাল্লা দিয়ে দৌড়তেন সত্তর দশকে। বুধবার সন্ধ্যায় সল্টলেকে তার বাড়ির সামনের পার্কে পিকের নশ্বরদেহ রাখা। তার সেই বিখ্যাত শিষ্যবাহিনী স্মৃতির আকাশে ভাসছেন সামান্য দূরে। তার কথায় মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া মানুষগুলো কোথায় গেলেন শেষদিন? নির্জন শেষমিছিলে পুষিয়ে দিতে আকাশে সন্ধ্যাতারাটি মারাত্মক জ্বলজ্বলে। সেও হয়তো জানতে এসেছিল, এত প্রাণশক্তির উৎস কোথায়? শেষ যে বার দেখা হলো গত বছর, সেদিন শুনেছিলাম, রাতে তার পুরনো ছাত্রদের কথা বলতে থাকেন ঘুমের মধ্যে। বিশেষ করে নাকি শ্যাম থাপা এবং সুভাষ ভৌমিক। দুপুর বারোটা নাগাদ সাহায্যকারিণী তমাকে ধরে টলোমলো এসে অসুস্থ পিকে অস্ফুটে স্বগতোক্তি করেছিলেন, ‘এইমাত্র আমার একজন প্লেয়ার মারা গেল। তলপেটে বল লেগে।’ সেই চিরচেনা তীক্ষè দৃষ্টি তখন আনমনা। সল্টলেকে তার বাড়ির বিস্তৃত বসার ঘরটি অন্তহীন হাহাকারে ভরে যায় সে সময়। অসুস্থ পিকের চিরায়ত তীক্ষè গলা হারিয়ে গিয়েছিল কয়েক বছর। পুরনো পিকে একবারই আলো ছড়িয়ে আনমনে বলে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘এ কথা জানিতে তুমি, ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান, কাল¯্রােতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান।’ নিজে যে আগের মতো নেই, ভাল বুঝতেন তিনি। ওই সময় মনে পড়েছিল ম্লান শীর্ণ সুপারস্টার রাজেশ খান্নার কথা। ক্যান্সারাক্রান্ত রাজেশ শেষদিকে মঞ্চে বলতেন সাহির লুধিয়ানভির লেখা ‘দাগ’ সিনেমার সংলাপ। ‘ইজ্জতে, শোহরতে, চাহতে, উল্ফতে/কৌই ভি চিজ দুনিয়া মে রহতে নহি/আজ ম্যায় হু যহাঁ, কাল কৌই আউর থা/এ ভি এক দৌড় হ্যায়, ও ভি এক দৌড় থা’। সব ভুলতে আমি ভাবি পূর্ণেন্দু পত্রীর একটা ছড়ার কথা, ‘খ্যাতি আসে যায়/কার খ্যাতি যায় টিকে/স্বনামধন্য পিকে।’ পিকে সত্যিই চিরকাল থেকে যাবেন বাঙালীর মননে। সন্ধ্যাতারার মতো। এই লোকের মাথায় অসামান্য সব আন্তর্জাতিক ভাবনা ডানা মেলত কোচ থাকার সময়। তখনও যা ভারতে আসেনি। তার অসংখ্য স্মরণীয় সংলাপের মতো মনে ভেসে আসে সব দৃশ্য। ডুরান্ড ফাইনালে মানস ভট্টাচার্যকে বসিয়ে সুভাষ ভৌমিককে নামিয়েছিলেন। চার পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করেন সুভাষ। আরারাত ম্যাচে প্রথমে সুব্রতকে সুইপার করে পাঁচ ডিফেন্ডার নিয়ে খেলছিলেন। ডিফেন্ডার কম্পটন দত্তকে বসিয়ে উইঙ্গার বিদেশ বসুকে নামিয়ে চমক আনা। ডিসিএমে তাইল্যান্ডের পোর্ট অথরিটি ম্যাচ ৩-১ থেকে ৩-৩ হয়ে ছিল। প্রায় অবসর নেয়া কাজল মুখোপাধ্যায়কে দু’মিনিট আগে নামিয়ে জয় আনা। কোরিয়ায় সুব্রত ভট্টাচার্যকে চিনাদের বিরুদ্ধে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার করে সাফল্য পাওয়া। তাইল্যান্ড ম্যাচে কৃশানু দে’কে টিপিক্যাল স্ট্রাইকার করে দেয়ার পর কৃশানুর হ্যাটট্রিক। প্রথম নেহরু কাপে প্রশান্তকে ‘ফ্রি ম্যান’ করে নামিয়ে দেয়া। কসমসের বিরুদ্ধে মাঝমাঠে লোক বাড়িয়ে পেলে-কিনাগ্লিয়াদের বিভ্রান্ত করার স্ট্র্যাটেজি। কত গল্প ইতিহাস হয়ে গিয়েছে শুধু পিকের জন্য? ছিয়াত্তর-সাতাত্তরে সুধীর-সুভাষ-সুব্রত-প্রসূন-গৌতমকে নিয়ে আলাদা মুভমেন্ট করিয়ে সাফল্য আনা। রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়ের স্পট জাম্প ভাল করাতে জলের মধ্যে লাফ দিতে বাধ্য করা। একবার ডিফেন্ডার রবীন দাসকে বড় ম্যাচে ফরোয়ার্ডে নামিয়ে জিতেছিলেন একবার। ডিফেন্ডার সুব্রতকে ফরোয়ার্ড করে নামিয়ে ম্যাচ জেতানোর ধারা শুরু পিকের আমলে। সে তো সবাই জানে। সুব্রত মঙ্গলবারই বলছিলেন, জার্নেল সিংয়ের স্টাইল দেখিয়ে আমাকে তুলে আনতেন। ক’জন মনে রেখেছে গোলকিপার শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফরোয়ার্ডে নামিয়ে ম্যাচ জেতার গল্প? ফুটবলারদের অহং বোধে ধাক্কা দিয়ে তাদের ভেতর আগুন জ্বালিয়েছেন কতবার যে! সুভাষ, সুরজিৎ, গৌতম, কৃশানু...আবেগের সব নাম। কৃশানুর একটা স্বর্গীয় স্মৃতি। ১৯৮৫ সালে ইস্টবেঙ্গল-মোহামেডান ম্যাচে পিকে প্রথম টিমে রাখেননি কৃশানুকে। তিনি কেঁদে ভাসিয়ে বুট খুলে রেখেছেন অপমানে। চিমার গোলে মোহামেডান জিতছে। পিকে কৃশানুকে নামালেন। আগুন হয়ে জ্বলে জেতালেন কৃশানু। এই কৃশানু বা প্রশান্তর মতো বল প্লেয়ারের পেছনে পুলিশম্যান লাগিয়ে আগুন নেভানোর কাজও তো কতবার করেছেন আমাদের পিকে। কত হারিয়ে যাওয়া মুখ ভেসে আসে পিকের পুলিশম্যান ভাবলে। সুনির্মল চক্রবর্তী, সুযশ বেরা, ক্রিস্টোফার, অমিত ভদ্র, দেবাশিস সরকার। প্রশান্ত বলছিলেন, ‘প্রদীপদাকে দেখে সব কোচ তারপর আমার পেছনে পুলিশম্যান লাগিয়ে দিতেন।’ ১৭ বছর আগে এই ২০ মার্চ কলকাতার এক অন্য প্রান্তে হাসপাতালে এভাবেই অনন্তের পথে হেঁটে যান পিকেরই অন্যতম প্রিয় ছাত্র কৃশানু। কৃশানু এবং প্রদীপ, দুই নামের অর্থেই আলোর সন্ধান থাকে। ২০ মার্চকে ভারতীয় ফুটবল মনে রাখবে আলো নিভে যাওয়ার জন্য। তার প্রাক্তন ছাত্রদের কাছে শোনা গল্প থেকে ধারণা ছিল, ভোকাল টনিকে নিজেদের যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা ভাবতে বলতেন পিকে। একবার জানতে চেয়েছিলাম, ঠিক কী বলতেন আপনি ছাত্রদের তাতাতে? পিকের কথাটা মনে গেঁথে যায়, ‘তোমার বাড়িতে রাতে শত্রু হানা দিয়েছে। বাড়িতে অস্ত্র কিছু নেই। কীভাবে সামলাতে হবে? বাড়ির মেয়েরা গরম জল করবে। লঙ্কা গুঁড়ো করবে। শঙ্খধ্বনি করবে পাশের বাড়ির লোককে জাগিয়ে তুলতে। তার পরে আমাদের পাল্টা আক্রমণ। এটাই কাউন্টার এ্যাটাক।’ কী ভাবে তাকে মনে রাখবে ভারতের ফুটবল ইতিহাস? এটা ভাবতে বসে কোনও দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব কাজ করে না। তিনিই ভারতীয় ফুটবলের সেরা ব্যক্তিত্ব। ফুটবলার জীবনে চুনী-বলরামকে নিয়ে গড়া ত্রিফলা হিরকদ্যুতির অন্যতম অংশ ছিলেন। কোচিং জীবনে অসংখ্য ট্রফি জয়ের সঙ্গে গুরু ছিলেন হাবিব-সুধীর-সুভাষ-গৌতম-শ্যাম-সুব্রত-সমরেশদের মতো অসংখ্য তারকার। বাংলা গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গায়ক-সুরকারের সত্তা ধরলে তিনি যেমন সেরা ব্যক্তিত্ব, ফুটবলে পিকেও তাই। তিনি শুধু বাংলার নন, ভারতের। তেন্ডুলকর, আনন্দ, উষা, মিলখা, গাভাসকর, অজিতপাল, পাড়ুকোন, ধনরাজ, রাঠোররা সবাই তাকে চেনেন এক ডাকে। চুনী ছাড়া এমন সন্ধ্যাতারা আর কে রইলেন বাংলার ফুটবলে? আন্তর্জাতিক ফুটবলে পিকের মতো তারকা কোচ-ফুটবলারের তুলনা জোহান ক্রুয়েফ ও জিনেদিন জিদান। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ারের কোচিং জীবন এমন দীর্ঘতম ছিল না। ক্রুয়েফ-জিদানকেও একটা জায়গায় হারতে হবে পিকের কাছে। পিকে বেতার ধারাবিবরণীতে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন বাংলায়। দারিদ্র্য এত প্রবল ছিল, ১৫ বছর বয়সে প্রথম চাকরিতে যান পিকে। জামশেদপুরে ইন্ডিয়ান কেবলস কোম্পানিতে এ্যাকাউন্টস ক্লার্ক। স্যালারি স্লিপ বানাতেন ৩৮০ জন কর্মীর। নিজে না খেয়ে পাঁচ ভাইকে মানুষ করেছেন। ফুটবল মাঠে প্র্যাক্টিস করে পাউরুটি-ডিম-কলা পেতেন, আনতেন ছোট ভাইদের জন্য। শেষ সাক্ষাতকারের দিন দেখি, কথা হারিয়ে গিয়েছে। সামনের লোককে চিনতে পারছেন না। তবু বিখ্যাত আন্তরিকতা, সৌজন্যবোধ হারাননি। সামনে প্লেটে খাবার রাখা আছে দেখে, বারবার বলছেন, ‘তোরা খা। খেয়ে নে। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।’ এত চমৎকার বাক্যবিন্যাস, রাজনীতি-সমাজতত্ত্ব-সংস্কৃতি-সাহিত্য নিয়ে নাগাড়ে কথা বলার উৎসাহটা কোথায় পেলেন পিকে? যে কোন বিষয়ের গভীরে ঢুকে যেতেন। তিনি নিজেই বলতেন, বাবা আমার রোল মডেল। মৃত্যুপথযাত্রী বাবা প্রভাত বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে উৎসাহ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন অলিম্পিকে অধিনায়কত্ব করতে। ‘বাবা বলেছিলেন, তুমি ৬৫ কোটি লোকের অধিনায়ক হয়ে যাচ্ছ। আমার গর্ব হচ্ছে। দেশের হয়ে খেলে এসো। আমি বেঁচে থাকব। আমি ফেরার পাঁচ দিন বাদে উনি মারা যান,’ বাবার কথা বলতে গিয়ে চোখ জলে ভরে যেত তার। ভারতীয় ফুটবলের প্রভাত-প্রদীপ নিভে গেল চিরদিনের জন্য। স্বর্গে প্রভাত-প্রদীপ দেখা হলে নতুন সূর্যের আলোর খোঁজ পাবেন ফুটবল ঈশ্বর। আকাশের সন্ধ্যাতারাটি সেই উজ্জ্বল আলোর সঙ্কেত দিয়ে গেল বিষণœ, জনহীন শেষ যাত্রায়। কৃতজ্ঞতায় এই সময়
×