ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাউন্টডাউন শুরু ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যা পাকিদের শেষ বর্বর রূপ

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

কাউন্টডাউন শুরু ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যা পাকিদের শেষ বর্বর রূপ

মুহম্মদ শফিকুর রহমান ॥ “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা তোমাকে পাওয়ার জন্যে আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়? আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন? তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর...” -শামসুর রাহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে আমাদের যত ত্যাগ শিকার করতে হয়েছে, যত রক্তাক্ত সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিতে হয়েছে, মা-বোনের সম্মানহানি হয়েছে, অতবড় ত্যাগ আর জীবন দান আর নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে এমনটি আর কখনও কোন জাতিকে সইতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেবল ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতি, ৫ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্মানহানি, জীবন বাঁচাতে ১ কোটি মানুষের দেশত্যাগ ও ভারতে আশ্রয়, দেশাভ্যন্তরে ৪ কোটি মানুষের ঘর-বাড়ি ছেড়ে আজ এখানে কাল ওখানে এমনি আশ্রয়হীন শঙ্কিত জীবন, পাশাপাশি মিত্রবাহিনী ভারতেরও ১৭ হাজার সৈন্যের জীবনহানি হয়। এমন সংক্ষিপ্ত সময়ে এত বড় ত্যাগ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও ঘটেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরও দীর্ঘ সময় চলেছে বলে জীবনহানিও বেশি হয়েছে সত্য। কিন্তু সে যুদ্ধ ছিল ৬ বছরের, অর্থাৎ সে যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবং শেষ হয় একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর, অর্থাৎ ৯ মাস। আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের “তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,” কবিতায় বাঙালীর ত্যাগ-তিতিক্ষার চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলা ভাষার কবির পাশাপাশি বিশ্বের অনেক কবির কবিতা, গল্প ও গানে স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং এখনও কবি, লেখকগণ লিখে চলেছেন। আমি মনে করি, একটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত রচনা বিরল ঘটনা। যেমনটি আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বাঙালীর জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের রেসকোর্সের ভাষণটি আড়াই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্থান পেয়েছে। সেটিও বড় কথা নয়, ভাষণটি যত শত-সহস্রবার বাজানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এমন নজিরও বিশ্বের কোথাও নেই। এই একটি ভাষণ সাড়ে ৭ কোটির একটি সম্পূর্ণ নিরস্ত্র জাতিকে এক মুহূর্তে সশস্ত্র করে তুলেছিল এবং ৯ মাসে পাকিস্তানী হানাদার সামরিক জান্তাকে পরাস্ত এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল। এ্যালেন গিন্সবার্গ। আমেরিকান কবি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাঝে সেপ্টেম্বর মাসে যশোর রোড দিয়ে বেনাপোল পর্যন্ত এসেছিলেন এবং কাদামাটি, বৃষ্টির মধ্যে জীবন বাঁচাতে ভারতে গমনরত মানুষদের, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দুর্দশার চিত্র : The September on Jessore road” কবিতায় আবদ্ধ করে রেখেছেন, তা আজও মানুষকে কাঁদায়: Millions of babies watching the skies Bellies swollen,with big round eyes On Jessore road- long bamboo huts No place to shit but sand channel rut Millions of fathers in rain Millions of mothers in pain Millions of brothers in woe Millions of sisters nowhere to go… বাংলা কাব্যরূপ [শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত মানুষের দল যশোর রোডের দুই ধারে বসত, বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল। কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে, আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে। ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘরবাড়ি দেশ, মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ। শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে, এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে...”] বিজয় ডিসেম্বর এক মহাজীবনের আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। এতে যেমন বিজয়ের আনন্দ আছে অর্থাৎ শত শত বছরের স্বপ্নসাধ বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সশস্ত্র যুদ্ধের বিজয় আছে, আছে প্রতিপক্ষ বর্বর পাকিস্তানের নতজানু সারেন্ডার, এর আনন্দই আলাদা। আবার এই মহাকাব্যের পেছনে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, মানবতার যে অপমান তার বেদনা কম নয়। কিন্তু পাকিরা এতই বর্বর যে, তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ডিসেম্বরের ১৩ ও ১৪ তারিখ দেশের বরণ্যে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ব্যয়নেট দিয়ে, গুলি করে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। শিক্ষক, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক এমনি তিন শতাধিককে হত্যা করে মাত্র দুই দিনে। যিনি শিক্ষক তার জিহ্বা কাটে, যিনি চোখের ডাক্তার তার চোখ উপড়ে, যিনি হার্টের ডাক্তার তার হার্ট বুকের মধ্যে থেকে বের করে, যিনি ছবি আঁকেন তার আঙ্গুল কেটে, যিনি বুদ্ধিজীবী তার চোখ-জিহ্বা-কলিজা তুলে নিয়ে কষ্ট দিয়ে, ব্যয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বা গুলি চালিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি জান্তা। পাকিদের সঙ্গে ছিল গোলাম আযম-নিজামীদের জামায়াত-শিবির, আলবদর, আলশামস। তারা ঢাকায় মিরপুর ও রায়েরবাজারে দুটি বদ্ধভূমি সৃষ্টি করে। তিন শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে, ব্যয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর ড. মুনীর চৌধুরী, প্রফেসর ড. জিসি দেব, প্রফেসর ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রফেসর ড. আনোয়ার পাশা, ডাক্তার আলীম চৌধুরী, প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ, প্রফেসর ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহিদুল্লাহ কায়সার, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, খন্দকার মোজাম্মেল হকসহ তিন শতাধিক বৃদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। পাকিরা এতই নৃশংস এবং বর্বর যে হত্যার আগে বুদ্ধিজীবীদের ওপর যে নির্যাতন চালায় সে বেদনার কথা বলে-লিখে শেষ করা যাবে না। বাঙালী সংগ্রামী জাতি। কোন পরাশক্তির কাছে মাথা নত করেনি। হাজার বছর ধরে লড়াই করেছে, তিতুমীর, ঈশা খাঁ, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ফেনীর শমশের গাজী, নাটোরের রানী ভবানী, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর অভিযাত্রা, কৃষক বিদ্রোহ, সিপাই বিদ্রোহ, নেতাজীর বিদ্রোহ, খেলাফত আন্দোলন কোনটাই ব্যর্থ হয়নি। তবে তা ছিল খ- খ-, বিছিন্ন, স্থানীয় এবং সাময়িক। যে কারণে জয়লাভ করেছে কিন্তু বিজয় ধরে রাখতে পারেনি। বারবার হেরেছে, বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে। বিগত শতাব্দীর আগে থেকে একঝাঁক দেশপ্রেমিক-বিপ্লবী, যেমন নেতাজী শুভাষ চন্দ্র বসু, সি আর দাশ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মীর মোশারফ হোসেন, আলাওল, তিতুমীর, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, রানী ভবানী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, শওকত আলী, স্যার সৈয়দ আহমেদ, মওলানা ইসলামাবাদী, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত, আব্দুল হাকিম, মুকুন্দ দাশ, জীবনানন্দ দাশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জয়নুল আবেদিন, জসীম উদ্দীনদের মাঝখান থেকে উঠে দাঁড়ান-রূপকথার এক রাজকুমার শেখ মুজিবুর রহমান, বিপ্লবী সাধারণ মানুষের বঙ্গবন্ধু, শেখের বেটা। বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে বললেন : -আর আমার বুকে গুলি চালাবার চেষ্টা করোনা - ভালো হবে না -সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না -This may be my test message to you from today : Bangladesh is Independent... রাতারাতি সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষ সশস্ত্র রূপ ধরে ৯ মাস যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করল। বিশ্বের বুকে অঙ্কিত হলো এক মর্যাদাপূর্ণ মানচিত্র, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী এই যুদ্ধে ভারত আমাদের সহযোদ্ধা ছিল এবং ভারতেরও ১৭ হাজার সৈন্য শহীদ হয়েছিল। বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নাম স্মরণ করতেই হয়। তাই আমাদের যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু, মুজিবনগর সরকারের জাতীয় ৪ নেতাসহ শহীদদের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধীকেও শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় স্মরণ করতে হয়, করছি। আমরা কৃতজ্ঞ জাতি। ঢাকা- ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সংসদ সদস্য সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×