ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবীর (সা) অতুলনীয় আদর্শ

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১০ নভেম্বর ২০১৯

নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মহানবীর (সা) অতুলনীয় আদর্শ

মহান আল্লাহ পাক পবিত্র এই রবিউল আউয়াল মাসে মানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-কে এই পৃথিবীতে শান্তির বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি পরিবার, সমাজ ও দেশের সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন। নারীদেরও তাদের যথাযোগ্য সম্মানিত আসনে ভূষিত করেছেন। কেননা আল্লাহ পাকের কাছে নারী ও পুরুষের মর্যাদা ভিন্ন নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কর্মনিষ্ঠ কোন ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করব না, তা সে পুরুষ হোক বা নারী’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯৫)। এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আমলের দিক থেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী, তাতে কিছু যায় আসে না। নারী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। সর্বত্রই নারীরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের সংবাদ পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই। যৌতুকের দায়ে নারীকে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, চুল কেটে ফেলা, টুকরো টুকরো করে লাশ ফেলে দেয়ার খবরে এখন আর কেউ কান দেয় না। সবাই জানে, এসব ঘটনা নৈমিত্তিক। এ ছাড়া নারীরা তো প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেই। নারীরা যেন আজ কোথাও নিরাপদ নয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীরা যেন এক মহা আতঙ্কে দিনাতিপাত করে। ইসলাম একজন নারীকে যে কত উচ্চ মর্যাদা দান করেছে, আজ তা সবাই ভুলতে বসেছে। বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তাতে মনে হয় আমরা আবার সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে বসবাস করছি। একটু চিন্তা করুন, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কেমন ছিল। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করত। রাতেরবেলায় নারী, মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব করত। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাকর মনে করত। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান করা হতো। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত, নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা)-এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা লাভ করে। তাঁর (সা) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহতায়ালা শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)। এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কি? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢেকে দেয়া। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে। কেননা, পোশাক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেত্রস্বরূপ’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২২৩)। একজন ভাল কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হেফাজত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে যে, নারীরা তাদের অমূল্য সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হেফাজত করা, তাদের ভাল-মন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম দাম্পত্য-জীবনযাপন করতে যেন কোন ত্রুটি না করে। নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবী (সা) বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই (সা) পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বস্তুত কুরআন করিমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে মায়েদের, স্ত্রীদের, কন্যাদের, স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদের-ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোন ধর্মই এভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেনি। একইভাবে, তিনি (সা) নারীদের স্বামীদের সম্পদের মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এ অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে সে তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবে। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও তিনি (সা) যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। একবার নামাজ পড়াবার সময় তিনি (সা) একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এ জন্য তিনি তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ানো শেষ করলেন। পরে বললেন, একটি বাচ্চা কাঁদছিল, আমার মনে হলো, ওর মায়ের মনে নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম, যাতে বাচ্চাটার মা তার বাচ্চার খবর নিতে পারে’ (বুখারী, কিতাবুস সালাত)। মহানবী (সা) যখন কোন সফরে যেতেন, তখন মহিলারাও সঙ্গে থাকতেন, যার ফলে সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলোকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করল, তখন তিনি বললেন, ‘আরে তোমরা করছ কি! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! অর্থাৎ, করছ কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবে উট দাবড়াতে থাকো, তাহলে তো ওই কাঁচগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে’ (বোখারী, কিতাবুল আদাব)। একবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। রাসূল করিম (সা) পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও পড়ে গিয়েছিলেন। এক সাহাবী পেছন থেকে রাসূল (সা)-এর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পা তখনও রেকাবের মধ্যে আটকে ছিল এবং তিনি ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি (সা) তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ওই সাহাবীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ঐদিকে, মেয়েদের দিকে যাও।’ রাসূল করিম (সা)-এর ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি (সা) সব মুসলমানদের সমবেত করে যে সব ওসিয়্যত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি কথা এই ছিল যে, ‘আমি তোমাদের আমার এই শেষ ওসিয়্যত (উপদেশ) করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’ এ কথাও তিনি প্রায়ই বলতেন যে, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শেখায় এবং ভালভাবে তরবিয়ত করে, কেয়ামতের দিন খোদাতায়ালা তার জন্য দোজখ হারাম করে দেবেন’ (তিরমিযি শরীফ)। সাধারণ আরবদের মধ্যে একটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীলোকরা যদি কোন ভুল-ত্রুটি করত, তবে তাদের মারধর করা হতো। হযরত রাসূল করিম (সা) যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নারীরা আল্লাহতায়ালার দাসী, তোমাদের নয়। তাদের কখনই মারধর করবে না।’ তিনি (সা) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি যে, সে খোদার দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’ এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী (সা)-এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)। হযরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রা) বলেছেন, ‘আমি রাসূল করিম (সা)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন, ‘খোদা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, খোদা তোমাকে যা পড়তে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পড়তে দাও এবং তাকে থাপ্পড়ও মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না’ (আবু দাউদ)। মহানবী (সা) বলেছেন, নারীদের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলবে। অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য। তাদের যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় আর সে জন্য অশোভন ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনও সংশোধিত হবে না আর এভাবে সেই হাড় ভেঙ্গে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের সংশোধন করতে হবে। ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে। তাই এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, ইসলামে মহানবী (সা) নারীর যে মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা বিরল। একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের লালনপালন, স্বামীর সেবাযতœ, সর্বোপরি একটি পরিবারকে আগলে রাখে একজন নারী। আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করে সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন। লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক [email protected]
×