ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি প্রচেষ্টা

প্রকাশিত: ০৮:৩৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শান্তি প্রচেষ্টা

ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলী এ বছর (২০১৯) শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্য তিনি এই সম্মাননা পেলেন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার শান্তি চুক্তিতে পৌঁছা। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুই দেশের সীমান্তে যুদ্ধ চলে। এরপর তাদের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক ছিল। প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ আলীর উদ্যোগের কারণে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মতোই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। এজন্য শান্তিপ্রতিষ্ঠা, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্নীতি প্রতিরোধ, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি ভূমিকা রাখার জন্য ৫ অক্টোবর (২০১৯) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের ‘টেগর শান্তি পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছেন। এর আগে বিশ্ব শান্তির অবিসংবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাও এ পুরস্কারে ভূষিত হন। কেবল এটির জন্য নয়, শেখ হাসিনা অনেক আগে থেকেই শান্তির অগ্রদূত হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক রাষ্ট্রনায়ক। তিনি ইউনেস্কো থেকে ১৯৯৮ সালে ‘হুপে-বোয়ানি’ শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। সর্বভারতীয় শান্তিসংঘ থেকে ১৯৯৮ সালে মাদার টেরেসা পুরস্কার পান। ‘মহাত্মা গান্ধী ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক ১৯৯৮ সালে এম কে গান্ধী পুরস্কার গ্রহণ করেন। অহিংস আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ২০১২ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি এবং উন্নয়নে অনন্য অবদানের জন্য ভারতের ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডক্টর অব লিটারেচার বা ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান করে। অন্যদিকে নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষা প্রসারের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে ইউনেস্কো ‘শান্তিবৃক্ষ’ পুরস্কার দেয়া হয়। শান্তি প্রচেষ্টায় মানবিকতা তাৎপর্যবহ। এজন্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে দায়িত্বশীল নীতি ও মানবিকতার জন্য আইপিএস ইন্টারন্যাশনাল এচিভমেন্ট এওয়ার্ড এবং ২০১৮ স্পেশাল ডিসটিংশন এওয়ার্ড ফর লিডারশিপ গ্রহণ করেন তিনি। চল্লিশের উর্ধে পদকজয়ী শেখ হাসিনা এখন কেবল শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হতে বাকি আছেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, নোবেল পুরস্কার নয়, বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসাকেই বড় মনে করেন তিনি। শান্তিতে নোবেল পাওয়া তাঁর কাছে কোন বিষয় নয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, এটাই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। তারা যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের মানুষ ততদিন তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবে। এবারের মতো ২০১৮ এবং ২০১৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি। সেসময় রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে ভূমিকার জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ‘শেখ হাসিনারই প্রাপ্য’ বলে মন্তব্য করে বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃবর্গ। কারণ শেখ হাসিনা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে কাজ করছেন। তাঁর এ কর্মের পরিধি অনেক আগেই বিস্তৃৃত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। মিয়ানমার থেকে ধেয়ে আসা ১১ লক্ষাধিক রাখাইন মুসলিমকে এদেশে আশ্রয় এবং শরণার্থী সমস্যাকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে নিজের নেতৃত্বকে আরও মহিমান্বিত করেছেন তিনি। মানবতার জন্য এমন নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরই নোবেল পাওয়ার কথা। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন এবং আর্ত-পীড়িতদের মধ্যে স্বস্তি সঞ্চারে যে দক্ষতাপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদর্শন করে চলেছেন শেখ হাসিনা, তার যথাযথ মূল্যায়ন করা হলে শান্তিতে তাঁরই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্য। জাতিসংঘে এবারের অধিবেশনেও মধ্যমণি ছিলেন শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাঁর বিচক্ষণতাপূর্ণ ভাষণ সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত হিসেবে আজ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে মহিমান্বিত একটি নাম। শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনের ভাষণে বলেছেন, ‘স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তি-কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘শান্তির সংস্কৃতি’ (culture of peace) শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ শান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনা বিশ্বসভার অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তি ও মানবতার এই দিশারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন; সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন ও বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর সেই আদর্শিক ধারায় স্নাত হয়ে শেখ হাসিনা মেধা ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন রাজনীতিক হিসেবে জনগণের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। জননেত্রীর নেতৃত্বে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অগ্রগতি অসামান্য। ১৯০১ সাল থেকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক কাজের জন্য এই পুরস্কার দেয়া হয়। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভয়ানক কিছু উল্টো ব্যাপার। বেশকিছু ব্যক্তিকে প্রায় অশান্তি আর রাজনীতি করার জন্যই নোবেল দেয়া হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আবার সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার পর শান্তিতে নোবেল পেয়ে নিজের জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন অনেকেই। কিন্তু বিশ্বজুড়ে মানব সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন এ রকম দৃষ্টান্তও রয়েছে। সেই ব্যর্থতা আমরা স্পষ্ট দেখছি মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে গণতন্ত্রের নেত্রী আউং সান সুচির আচরণে। তিনি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনদের চলমান সহিংসতায় বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে হাজারো বাড়িঘর। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সুচি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় নিশ্চুপ। সুচির এই ভূমিকায় তাঁর সমালোচনা যাঁরা করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুও। তিনি ১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেল পান। অন্যদিকে ২০০৬ সালে প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুছকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সে জন্য তিনিও নিশ্চুপ। দেশের ভেতর ২০১৪-১৫ সালজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোল বোমার নাশকতার বিরুদ্ধে তাঁকে কিছু বলতে শোনা যায়নি। ২০০৯ সালে বারাক ওবামাকে শান্তিতে নোবেল দেয়ার ঘটনাও সমালোচিত হয়। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ না করেও এভাবে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন একাধিকজন। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েও যাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে না পেরে সমালোচিত হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম ইসরাইলি নেতা মেনাচেম বেগিন। ১৯৮২ সালে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। এর মাত্র চার বছর আগেই ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি সই করে মিসরের আনোয়ার সাদাতের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল ভাগাভাগি করে নেন তিনি। ১৯৮১ সালে ইসলামপন্থী এক সেনাসদস্যের হাতে খুন হন সাদাত। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উত্তর ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। যে প্রচেষ্টার জন্য তাঁরা এই পুরস্কার পান, সেটা ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। থো এ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন শান্তিতে। তাঁর অভিযোগ ছিল, ওয়াশিংটন যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এভাবে তালিকা ও বর্ণনা দিয়ে শান্তিতে নোবেল পাওয়া ব্যক্তিদের অবদানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু শেষ করলে যা দাঁড়াবে তা হলো- শেখ হাসিনা কখনও পুরস্কার পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করেন না। তিনি জনগণের নেত্রী হিসেবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাহসের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। মানুষের ভালবাসাই তাঁর বড় অর্জন। মানবতার দিক থেকে শেখ হাসিনা একজন আদর্শ বাঙালী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কন্যা এবং আবহমান কাল ধরে চলে আসা বাঙালী নারীর আদর্শ প্রতিমূর্তি। দেশ ও বিশ্বের যে কোন সঙ্কটে তাঁর নেতৃত্ব দলমত নির্বিশেষ সকল রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। সেখানে দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। বাঙালী এক নারী পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে দুঃসহ স্মৃতির রক্তক্ষরণকে জয় করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; লড়াই করছেন শুধু গণতন্ত্রের জন্যই নয়, সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই- তাঁর সেই সংগ্রাম শান্তি ও মানবতার জন্য। এজন্য শান্তিতে নোবেল পাওয়ার বিষয়টি তাঁর কাছে তুচ্ছ। তিনি ‘বিপন্ন মানবতার বাতিঘর’; ‘মানবতার জননী’। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×