ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাদ্দাফীর লিবিয়া

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গাদ্দাফীর লিবিয়া

১৯৮০-এর মাঝামাঝি আমি সরকারী কাজে একবার লিবিয়া গিয়েছিলাম। রাজধানী ত্রিপলী ও আলজিনতান শহর এবং মাঝামাঝি দেশটির ধূলি-ধূসর প্রকৃতি দেখেছি। আর ত্রিপলীতে দেশটির একচ্ছত্র সামরিক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার। সরকারী বিশাল প্রাসাদের সামনে তার চেয়ে আরও বিশাল প্রাঙ্গণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুদৃশ্য তাঁবুতে তিনি আমাদের দেখা দিয়েছিলেন। লিবিয়ার সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের নিমিত্ত তার তাঁবুতে বাস। প্রাকৃতিক তেলের অন্যতম নিলয় হিসেবে লিবিয়ার সম্পদ প্রতুলতা কিভাবে দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে প্রযুক্ত করবেন তা জানতে চেয়েছি আমি তার কাছে। স্মিত হাসি হেসে তিনি প্রত্যুত্তরে তার আলখাল্লার পকেট থেকে দিয়েছিলেন আমাকে তার গ্রীন বুক বা সবুজ কেতাব। বললেন, সব লেখা আছে এতে। হোটেলে এসে ওখানকার সহযোগীদের সহায়তায় পড়লাম সেই কেতাব, তার ভাষ্যে লিবিয়ার উন্নয়নের ইশতেহার। দুঃখের সঙ্গে অনুধাবন করলাম, নিজের অদম্য ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা ও স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের সমর্থনে দেশের সম্পদ প্রয়োগ এবং আত্ম প্রশংসা ছাড়া ভিন্নতর কিছু সবুজ কেতাবে নেই। দরিদ্র বেদুইন পরিবারে জন্ম নিয়ে গাদ্দাফী বেনগাজীতে তখনকার রাজকীয় সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে লিবিয়ার সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে কর্নেল পদে উন্নীত হন। ১৯৬৯ সালে কর্নেল পদের গাদ্দাফী সামরিক বিপ্লবের নেতা হিসেবে লিবিয়ার তৎকালীন নৃপতি ইদ্রিসকে দেশচ্যুত করে দেশের সর্বময় ক্ষমতা দখলে নিয়ে এক বিপ্লবী হুকুমদার কাউন্সিলের মাধ্যমে ফরমান দিয়ে দেশ ও সমাজ শাসন শুরু করেন। ১৯৬৯ থেকে ৭৭ পর্যন্ত তার পোশাকী স্বআরোপিত পদবী ছিল লিবিয়ার বিপ্লবী হুকুমদার কাউন্সিলের সভাপতি। তার অধীনে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় হুকুম পালন করেন ক্রমান্বয়ে ৩ প্রধানমন্ত্রী-মাহফুজ আল মাগরেবী, সালাম জাল্লুদ ও আতি আল ওবাদী। ১৯৭৭ এর মার্চ থেকে ১৯৭৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এই একক ক্ষমতাধারী গাদ্দাফী নিজেকে অভিহিত করেন লিবিয়ার জন কংগ্রেসের মহাসচিব নামে। তার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন আতি আল ওবাদী। এই সময়ে প্রায় ১ বছরের জন্য গাদ্দাফী আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ এ জন কংগ্রেসের মহাসচিবের পদ ত্যাগ করে গাদ্দাফী সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজের কাছে রেখে নিজেকে লিবিয়ার বিপ্লবের নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন। লিবিয়ার প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ তেলের উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানোর জন্য গাদ্দাফী উচ্চাভিলাসী অথচ অবান্তর কার্যক্রম তার সরকারের প্রথম থেকেই শুরু করেছিলেন। ১৯৭৩-এ তিনি ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামসহ লিবিয়ায় উৎপাদন ও বিপণনরত সকল বিদেশী কোম্পানিসমূহের ৫১% জাতীয়করণ করেন। এই সময়ে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বাড়ায় লিবিয়ার সরকারের আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই আয়ের ভিত্তিতে গাদ্দাফী লিবিয়ার সেচ ব্যবস্থা প্রসারণের ভিত্তিতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রম হাত দেন। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বহির্ভূত লোক দেখানো প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেখা যায় যে, উৎপাদন ব্যয় উৎপাদিত ফসলের মূল্য থেকে অনেক বেশি হয়ে গেছে। তিনি লিবিয়ার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন, ফরমান দিয়ে শাসন পোক্ত করতে থাকেন, শরীয়াকে আইনের ও বিচার প্রক্রিয়ার ভিত্তি হিসেবে প্রবর্তন করেন এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রতিপত্তি খর্ব করতে থাকেন। তিনি ইতালি থেকে আগত সকল উপনিবেশীর জোত জমি বাজেয়াফত করেন, আরবীকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে আরোপিত করেন, মদ, জুয়া, নৈশক্লাব বন্ধ করেন, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা প্রসারিত করেন। তার সরকার সকল আমদানি, রফতানি ও পণ্যসামগ্রী বিতরণের কাজ ও দায়িত্ব গ্রহণ এবং সকলের জন্য সম্পদের সমতা বিধান ও বিতরণের অপক্ব কার্যক্রম ঘোষণা করে, ১০০০ দিনারের বেশি ব্যাংককে গচ্ছিত সকল ব্যক্তি আমানত বাজেয়াপ্ত করে, মহিলাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার বিধান দেয়। তার ভাষায় তার বিপ্লব সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ও ইউরোপ-আমেরিকার ধনতন্ত্রকে পরিত্যজ্য বিবেচনা করে ইসলাম ধর্মভিত্তিক আরবী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। এই সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অর্থ শক্তিতে মদমত্ত হয়ে গাদ্দাফী বিপ্লব রফতানি শুরু করেন। ১৯৭৩-৭৯ পর্যন্ত গাদ্দাফী জায়ারে ও উগান্ডায় তার মতবাদ অনুসরণের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেন। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গাদ্দাফীর দেখা হয়। গাদ্দাফীর দাম্ভিক কথা ও আচরণে বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম হত্যাকারী ঘৃণিত কর্নেল রশীদকে ইসলাম ধর্ম অনুসারী হিসেবে গাদ্দাফী লিবিয়াতে স্থায়ী আশ্রয় দেন এবং বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির ব্যবসা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন। পাকিস্তানের তখনকার নীতিভ্রষ্ট শাসক জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গেও গাদ্দাফী এই সময়ে সখ্য গড়ে তোলেন। ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবিতে প্যান এম ফ্লাইট ১০৩ কে ২৫৯ যাত্রী ও কর্মীসহ ধ্বংস করণে তার প্রেরণা ও সহায়তা ছিল বলে অভিযোগ উঠে। তার মনগড়া সমাজতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে তার বিরুদ্ধে ২০১১-এর আরব বসন্তের সময় থেকে জনমত প্রতিকূলে যেতে থাকে। বিরোধী জনগণকে দমন করতে গাদ্দাফী নিষ্ঠুর ও অমানবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকেন। ফলত জাতীয় ক্রান্তি কাউন্সিল গঠন করে বেশ কয়েকজন সামনের সারির বিরোধী নেতা বেনগাজী শহরকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে মোর্চা গড়ে তুলেন। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ এ অর্বাচীনের মতো গাদ্দাফী, ‘আন্তর্জাতিক আল গাদ্দাফী মানবাধিকার পুরস্কার’ প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। কালক্রমে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম বিস্তৃত হয়। ২০১১ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল লিবিয়াকে মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বহিষ্কার করে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে গণহত্যার দায়ে গাদ্দাফীর বিচার করার অনুশাসন দেয়। সেই বছরে জুন মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। জুলাই এর মধ্যে ৩০টি দেশ গাদ্দফীকে অবজ্ঞা করে জাতীয় ক্রান্তি কাউন্সিলকে লিবিয়ার বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি গাদ্দাফীকে অপরাধী বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সকল দল ও গোষ্ঠীকে সক্রিয় ও সশস্ত্র সমর্থন দিতে থাকে। ২০১১ সালে গাদ্দাফী কাউন্সিল সরকারের সৈন্য ও সমর্থকদের হাতে পৈশাচিক নির্যাতনে করুণ ও নির্মমভাবে নিহত হন। লিবিয়ার এক অজ্ঞাত স্থানে তাকে কবরস্থ করা হয়। গাদ্দাফীর পর এখন পর্যন্ত লিবিয়া গৃহযুদ্ধে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গাদ্দাফীর শাসনের শেষ ভাগে সুনির্দিষ্ট আইনের শাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও জাতিগত ঐক্যের অনুপস্থিতিতে লিবিয়ায় দল ও গোষ্ঠীগত কোন্দল শুরু হয়। ২০১৪ সালে এক বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে তবরুক নগর কেন্দ্রিক ‘জনপ্রতিনিধিদের নিলয়’ নামীয় সরকার গঠিত হয়। এর বিপরীতে সাধারণ জাতীয় কংগ্রেসের আওতায় ত্রিপলীতে পৃথক ‘জাতীয় পরিত্রাণ সরকার’ গঠিত হয়। তবরুক কেন্দ্রিক সরকার জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সরকারকে সহায়তা করে আসছে। এর বিপরীতে ত্রিপলী কেন্দ্রিক জাতীয় পরিত্রাণ সরকার কাতার, সুদান ও তুরস্কের সহায়তাসহ পরিচালিত হতে থাকে। ২০১৫ এ তবরুক ও ত্রিপলী কেন্দ্রিক দুই বিরোধী শক্তি অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সরকার ত্রিপলী কেন্দ্রিক কর্তৃত্বের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। তথাপিও তবরুক কেন্দ্রিক সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্যান্য দলের সমর্থনের অভাবে ত্রিপলীভিত্তিক সরকার তার কর্তৃত্ব দেশের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। তদুপরি ইরাক ও লেভান্তের ইসলামী রাষ্ট্রের মোড়কে মৌলবাদীরা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালাতে থাকে। ২০১৪ এর ২৭ আগস্ট জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল তাৎক্ষনিক যুদ্ধ বিরতির ভিত্তিতে বিবদমান দল ও গোষ্ঠীসমূহকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানায়। ইতালি নিরাপত্তা কাউন্সিলের আহ্বান অনুযায়ী ত্রিপলী কেন্দ্রিক সরকারকে সহায়তা করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করে। অন্যদিকে জেনারেল হাফতার বেনগাজীকে কেন্দ্র করে ঐ এলাকায় সরকার গঠন করেন। তুরস্ক হাফতারের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতিকূলে পশ্চিম অঞ্চলে ফায়েজ সিরাজের সরকারকে সামরিক সহায়তা দিতে থাকে। ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য গৃহযুদ্ধ নিরসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামী রাষ্ট্রের নির্মূল দাবি করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী আলোচনার অনুকূলে অবস্থান নিয়ে হাফতারের কর্তৃত্বকে সমর্থন জানায়। যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধ বিমান প্রযুক্ত করে এবং এদের আক্রমণে ২০১৫ সালে লিবিয়ার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান নিহত হন। ২০১৭ এর সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র তেমনি বিমান হামলা চালিয়ে ১৭ জন ইসলামী রাষ্ট্রের সৈন্যকে নিহত করে। ঐক্যের অবর্তমানে লিবিয়ার বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এখনও একে অন্যের বিরুদ্ধে প্ররোচিত ও যুদ্ধ করে যাচ্ছে। গৃহযুদ্ধের ফলে লিবিয়ার অর্থব্যবস্থা ধ্বংসের পথে চলে, ব্যবসাবাণিজ্য স্তিমিত হয়ে যায় এবং তেল থেকে আহরণীয় আয়ের ৯০% ভাগ বন্ধ হয়ে যায়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা সমূহের হিসাব অনুযায়ী লিবিয়ার অন্তঃকলহে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ লোক প্রাণ হারিয়েছে। লিবিয়ার সমকালীন অনেক্য, বিভেদ ও গৃহযুদ্ধ মূলত গাদ্দাফীর কৃতকর্ম হিসেবে বিবেচ্য। গাদ্দাফী তার সবুজ কেতাবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সা¤্রাজ্যবাদী সমাজ বলে প্রত্যাখ্যান করে বিকল্পে আরব জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকরণের আহ্বান জানান। তার সবুজ কেতাব প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করে, অসজ্ঞায়িত ইসলামী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায় অথচ তার শাসনামলের শেষ দিকে সামাজিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় স্থিতাবস্থা রাখার অনুকূলে মত দেয়। তিনি এই শেষোক্ত মতের যৌক্তিকতা স্থাপনে হাদিসের ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে কেবলমাত্র মূল কোরানকে ভিত্তি করে সমাজকে এগিয়ে নেয়ার বিধান প্রকাশ করতে থাকেন। এই সকল কিছু গাদ্দাফীকে জনগণের কাছে জবাবদিহিত্বের বাইরে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা ভিত্তিক স্বৈরশাসক হিসেবে বিবেকবান সকলের কাছে পরিচিত করে। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বাইরে যে কোন শাসক বা শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী মঙ্গল আনতে ও সংরক্ষণ করতে সক্ষম নয়, গাদ্দাফী তার কর্মকা-ে তাই প্রমাণ করেছেন। সততার নিরিখে গাদ্দাফী কোন বিচারেই সমালোচনার উর্ধে ছিলেন না। লিবিয়ার এত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও গাদ্দাফী তার দেশের সার্বিক ও স্থায়ী উন্নয়ন করতে সক্ষম হননি। ২০১১ সালেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলারে ২০০ বিলিয়নে প্রাক্কলিত হয়েছিল (উৎস উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ)। নিঃসন্দেহে এই সম্পদ লিবিয়ার জনগণ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সম্পদ। পৃথিবীর অধিকাংশ স্বৈরশাসকরা এভাবে জনগণের সম্পদ লুট করেছে, নিশ্চিতভাবে তা বলা চলে। লিবিয়ায় গাদ্দাফী সৃষ্ট তা-ব ও অব্যবস্থাপনা এ সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, জনগণের সমর্থনের বাইরে অস্ত্রবলে স্বৈরশাসক হওয়া যায় কিন্তু জনকল্যাণে ও উন্নয়নে নিবেদিত ব্যবস্থার সারথী হওয়া যায় না। ভিয়েতনামের নাগোদিন দিয়েম, ইরানের শাহ, ইরাকের সাদ্দাম, সাম্প্রতিককালের জিম্বাবুয়ের মুগাবে স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রচ্ছায়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে মাটিতে লুটিয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই স্থান নিয়েছিলেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সংসদে স্বৈরশাসক এরশাদের মরণোত্তর জীবনালেখ্য মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়ায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশে অস্ত্রের বলে সংবিধান লঙ্ঘন করে গণতন্ত্র হত্যাকারী স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে রাষ্ট্রপতি বলে আখ্যায়িত বা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে স্বৈরশাসনের প্রতিকূলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘৃণা ও অগ্রহনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। (দ্রষ্টব্য, দৈনিক আমাদের সময়, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৯)। এসব স্বৈরশাসকদের সুইজারল্যান্ড, লেইচেনস্টাইন, মেকাও বা যুক্তরাষ্ট্রে গচ্ছিত সম্পদ তাদের দেশের জনগণের লুণ্ঠিত সম্পদ বলেই বিবেচ্য। গত ২৫ আগস্ট ফ্রান্সের বিয়ারটিজে জি-৭ এর অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলনে লিবিয়ার গাদ্দাফী উত্তর বহমান গৃহযুদ্ধ পৃথিবীর ৭টি বিত্ত ও শক্তিশালী দেশসমূহের প্রধানরা আলোচনান্তে জাতিষংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় সুস্থ, গণতান্ত্রিক উৎপাদনশীল ও জনকল্যাণমুখী সরকার স্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য, জি-৭ এর শীর্ষ সম্মেলন, ২০১৯, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)। বিশ্ববাসী আশা করে যে লিবিয়ার বিবদমান দল ও গোষ্ঠী এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনকল্যাণ ও উন্নয়নের ধারক ও বাহক হিসেবে তাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং ব্যক্তি বিশেষের মদমত্ততায় স্বৈরতান্ত্রিকতার তাজ মাথায় ধারণ করে দেশ পরিচালনা করার প্রবণতা তাদের দেশ থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে জনকল্যাণ প্রসারণের নিশ্চয়তা দিবেন। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×