ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১;###;শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

অপারেশন বানারীপাড়া

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

অপারেশন বানারীপাড়া

১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল সোমবার। এই দিন মুক্তিফৌজের উর্ধতন কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাপ্রধান লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং হয়। একসঙ্গে গেরিলা ও নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারতীয় কমান্ডারের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সরকারেরই সিদ্ধান্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকবাহিনীর যে কোন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত আছে। এতে মুক্তিফৌজ খুবই অনুপ্রাণিত হয় এবং এরই মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়রা আরও গভীরভাবে যুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী লে. মোরশেদের নেতৃত্বে আখাউড়া-হরশপুর রেলওয়ে লাইনে মুকুন্দপুরের কাছে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে তার সাথে বৈদ্যুতিক তার সংযোগ স্থাপন করে ৩০০ গজ দূরে রিমোট কন্ট্রোল স্থাপন করে অবস্থান নেয়। পাক বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন এ্যামবুশ অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে মাইনের ওপরে এলে মুক্তিযোদ্ধারা সুইচ টিপে মাইন বিস্ফোরণ করে। এতে ইঞ্জিনসহ ট্রেনটি বিধ্বস্ত হয় এবং দুজন অফিসারসহ ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায় ট্রেন ধ্বংস এটাই প্রথম। সিলেটে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন যোদ্ধার একটি দল পাকসেনাদের শাহবাজপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। ১০ মিনিট পর পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী অক্ষত অবস্থায় নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। ৭নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী রামচন্দ্রপুর পাক বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাক বাহিনীর ২০ জন সৈন্য ও ১২ জন রাজাকার নিহত এবং ১৩ জন সৈন্য আহত হয়। অপর পক্ষে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও দু’জন যোদ্ধা আহত হন। মুক্তিবাহিনী খুলনার হরিনগরে পাক বাহিনীর একটি গানবোট ও সৈন্য বোঝাই কিছু লঞ্চকে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাক বাহিনীর গানবোট আরোহী নিহত এবং রাডার এন্টিনা ধ্বংস হয়। পরে প্রচ- গোলা বিনিময়ে পাকসেনাদের ৪টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায়। মুক্তিবাহিনী বানারীপাড়ায় ৩টি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়। প্রায় ৪০ পাকসৈন্য নদীতে ডুবে মারা যায় বলে অনুমান করা হয়। এই সেক্টরে গত কয়েক দিনে বিপুল সংখ্যক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুষ্টিয়ায় একটি ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ২২ জন রাজাকার ও অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ৮নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী বানারীপাড়ায় পাকবাহিনীর কয়েকটি লঞ্চ আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাক বাহিনীর ৩টি লঞ্চ পানিতে ডুবে যায় এবং ৪০ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। তাজিশ্বর ও বগাবাড়ি এলাকায় বিপর্যস্ত অবস্থায় পাকসেনাদের সাহায্যের জন্য পাঁচটি জঙ্গী বিমান বিকেল পাঁচটার সময় মুক্তিফৌজের অবস্থানগুলোর ওপর এক ঘণ্টাব্যাপী প্রচ- বোমাবর্ষণ করে। পাকসেনাদের বিমান হামলা মুক্তিফৌজের সৈনিকদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। তারা শত্রুর চাপের মুখেও তাদের অবস্থানে অটল থাকে। পাকসেনারা এই সেক্টরে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। এই দিন বাংলাদেশে হানাদারদের গণহত্যার প্রতিবাদে ইসলামাবাদের বিদেশস্থ দূতাবাসের আরও একজন বাঙালী কূটনীতিবিদ চাকরিতে ইস্তফা দিয়া লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে যোগদান করেন। তিনি হচ্ছেন মহিউদ্দিন জোয়ার্দার। জনাব মহিউদ্দিন লাগোস এবং নাইজিরিয়ার ইসলামাবাদ মিশনের চেন্সরি প্রধান ছিলেন এবং কখনও কখনও অস্থায়ী হাইকমিশনার হিসেবে কাজ করতেন। একই দিনে ম্যানিলার ইসলামাবাদ দূতাবাসের প্রধান জনাব খুররম খান পন্নী ইসলামাবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। গত বছর মার্চ মাসে তিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ম্যানিলা গমন করেন। তাঁর পদত্যাগের পূর্বে হংকংস্থ ইসলামাবাদ মিশনের প্রধান জনাব মহসীন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সমর্থনে এ পর্যন্ত বিদেশে ইসলামাবাদ কূটনৈতিক মিশনসমূহের ৪০ জন কূটনীতিবিদ ইসলামাবাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। জনাব পন্নীর পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এখনও কিছু বলেননি। অপর একটি সূত্র হতে জানা যায়, সম্প্রতি ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ তাকে ইসলামাবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য বার্তা পাঠিয়েছিল। জনাব পন্নীর পদত্যাগের পর এখন কেবল পিকিংয়েই ইসলামাবাদের বাঙালী কূটনীতিবিদ অবশিষ্ট রইল। পিকিংস্থ ইসলামাবাদ দূতাবাসের এই বাঙালী কূটনীতিবিদ হলেন জনাব কায়সার। জানা যায়, তিনিও ইসলামাবাদ জঙ্গী শাহীর কোপা দৃষ্টিতে আছেন। কারণ, ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ নীতির প্রতি পিকিং সরকারের সমর্থনের ফলে বাঙালী কূটনীতিবিদ কায়সার খুবই অসুবিধায় পড়েছেন। তিনি আর নিজেকে পিকিংয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াইতে পারছেন না। ইতোমধ্যেই তার গতিবিধির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। জনাব কায়সারকে হংকং যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। জনাব পন্নীর পদত্যাগের আভাস পূর্বেই পাওয়া যায়। সম্প্রতি ম্যানিলায় প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড মারকোসের নিকট হতে একটি পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে পন্নী ইচ্ছাকৃতভাবেই পাকিস্তান সরকার কথাটি একবারও উচ্চারণ করেননি। জনাব পন্নী ম্যানিলায় বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে তথায় বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন। চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপর বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চারদিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অবাঙালী ও বিহারীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় পাকিস্তান সরকার বিহারীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং তাদের প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ না করায় ওয়্যারলেস কলোনি ও শের শাহ্্ কলোনির বিহারীরা মিছিল বের করে। মিছিলে স্লোগান দেয়- ‘বাঙালী বিহারী ভাই ভাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই।’ তাদের এই স্লেøাগান প্রহসন ও ষড়যন্ত্রের একটি বড় অংশ। এতে জনগণ আরও সতর্ক ও সচেতন হয়। কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধি এইচসি টেম্পেল্টন বলেন, ‘আমাদের দেশের পক্ষ থেকে কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করছি। গায়ানা প্রতিনিধি মি. বিসেম্বর বলেন, আমি আন্তর্জাতিক মানদ-ে এটা বিশ্বাসও করি না আবার অবিশ্বাসও করি না যে, আমাদের স্বাধীন কোন অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে কি না। কিন্তু আমি এটাই পেশ করছি জনাব সভাপতি, যে যেখানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, যেখানে মানবতার অবমূল্যায়ন এবং যেখানে নৈতিকতার বিসর্জন হয়ে পড়ে এবং একই সঙ্গে সকল আন্তর্জাতিক নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়, তখন এটা আমাদের মতো সকল কমনওয়েলথ সদস্যের একটি অধিকার ও কর্তব্য হয়ে পড়ে এমন কোন সভায় নিজেদের মতো ব্যক্ত করা। মি. চেয়ারম্যান, পাকিস্তানে বসবাসকারী মানুষের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমরা কীভাবে এই সভা পাকিস্তানে করার চিন্তা করতে পারি যেখানে তারা একে নির্বাচন বলে, এবং সেই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান জয়লাভ করার পরেও পাকিস্তানে কোন সরকার গঠন করার কোন অনুমতি পায়না। কারন ভারত এবং পাকিস্তানে যা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা বর্তমান পৃথিবীতে আর কিছু নেই... সুতরাং মি. চেয়ারম্যান, আমি মনে করি আমার জানা মতে আমরা যারা এখানে ৩০টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাদের কোনভাবেই এই ভয়াবহ নৃশংসতার নিন্দা প্রকাশ থেকে পিছিয়ে আসা উচিত নয়। নিন্দা প্রকাশ করা উচিত তাদের প্রতি যারা গণতান্ত্রিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছে এবং একই সঙ্গে লঙ্ঘন করেছে সংবিধানকে এবং ভারতীয় জনগণের ওপরে বয়ে এনেছে সীমাহীন নৃশংসতা ও ভয়াবহ দুর্ভোগ। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×