ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সভ্যতার উষালগ্ন মিসর

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১০ নভেম্বর ২০১৭

সভ্যতার উষালগ্ন মিসর

লাউঞ্জে পা রাখতেই মুগ্ধতায় ভরে যায় মন। ছিমছাম সাজানো গোছানো, ছোট কিন্তু আন্তরিকতায় ভরা। অন্যান্য এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে যা থাকে ছোট পরিসরে তার সব থাকলেও বাজারি ভাবটা নেই। সরল সৌন্দর্যের ছোঁয়া সবখানে। আর কোন দেশের এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বাহরাইনের মতো এমন সিগ্ধ রুচির ছোঁয়া দেখিনি। স্টারবাকস, গ্লোরিয়া জিন্সের মতো কফি শপগুলো ওয়েটিং এরিয়ার একেবারে নাগালে। তা দেখে ঢাকার কফি কালচারে অভ্যস্ত আমার তরুণ-কিশোর দুই সহযাত্রী আনন্দে আত্মহারা। ইস্তানবুল এয়ারপোর্টে অনেক খুঁজে স্টারবাকসের সন্ধান পেয়েছিল তারা। ঢাকায় ব্রেড এ্যান্ড বিয়ন্ড, নর্থ এন্ড, ক্রিমসন কাপ, তাবাক ইত্যাদিতে স্বাদ বদলাতে পারলেও স্টারবাকসের স্বাদ নেয়ার সুযোগ হয় তাদের দেশের বাইরে এলেই। সুতরাং যাত্রা বিরতির পুরো সময় মেজাজ খোশ। এক জনের ‘প্রাইড এ্যান্ড প্রিজুডিস’ অন্য জনের ‘হাউ টু রিড পেইন্টিংস’ ঢুকে যায় যার যার ডিভাইসে। কফির মগে চুমুক দিয়ে বাদশাহী মেজাজে বিশ্রম্ভালাপ শুরু হয় তাদের। আমরা আছি ‘মিসর তত্ত্ব’ ঘোরে। একখানা ‘বেসাল্ট পাথর’ কি করে আধুনিক মানুষের সামনে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার দ্বার উন্মোচন করল তা ভেবে অবাক হয়েছি বার বার। মিথ মমি ফারাও পিরামিড প্যাপরাস আর হায়ারো গ্লাইফিক লিপির রহস্যময় মিসরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস পাঠের সূত্র তুলে ধরেছিল ‘রোজেটা পাথর’ নামে পরিচিত ওই বেসাল্ট শিলালিপি। নীল নদের ‘রোজেটা’ বাঁকে এটি পেয়েছিলেন এক ফরাসী সৈনিক। নেপোলিয়নের মিসর আক্রমণের সময়, সতেরো শ’ নিরানব্বই সালে। পাঠোদ্বার যিনি করেছিলেন তিনিও ফরাসী। সাঁপোলিয়ঁ নামে ওই ফরাসী ভাষাতাত্ত্বি¡ক ‘টলেমি’ এবং ক্লিওপেট্রা’ এই দুটি মাত্র পরিচিত গ্রীক শব্দ সম্বল করে সম্পূর্ণ অপরিচিত, দুর্বোধ্য হায়রোগ্লাইফিক লিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন দীর্ঘ পরিশ্রমের পর। ঢাকা থেকে বাহরাইনের পথে হলিউডের ‘ক্লিওপেট্রা’ দেখা হলো আরও একবার। টলেমি যুগের মিসরের রানীর খেতাব ছিল ক্লিওপেট্রা। জুলিয়াস সিজারের আলেক্সান্দ্রিয়া অভিযানের সময় মিসর চলছিল ক্লিওপেট্রার শাসনে। মুগ্ধ সিজার প্রেমে পড়েছিলেন তার। তাকে নিজের করে পেতেন কিনা সে প্রশ্ন পরের। তার আগেই খুন হয়েছিলেন গুপ্তঘাতকের হাতে। ক্লিওপেট্রার রাজত্বে এর পরের অধ্যায়ে প্রবেশ আরেক রোমান বীর মার্ক এ্যান্টেনির। যার সমস্ত বীরত্ব হার মেনেছিল রানীর সৌন্দর্যের কাছে। ভুলিয়ে দিয়েছিল তার ওপর আরোপিত দায়িত্বের গুরুভার। শেক্সপিয়ারের এ্যান্টোনি ও ক্লিওপেট্রা নাটকে। এরা অমর হয়ে আছেন। ক্লিওপেট্রার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সৌন্দর্য এবং ষড়যন্ত্রের জালে বিদ্ধ মার্ক এ্যান্টোনিকে দিয়ে শেক্সপিয়ার বলিয়েছেন। I am dying, Egypt dying; only I here importune death a whail until Of maû thousand kisses the poor last I lay upon thy lips I am dying, Egypt dying; only I here importune death a whail until Of maû thousand kisses the poor last I lay upon thy lips ‘আমি মরে যাচ্ছি, মিসর মরে যাচ্ছে; শুধু চাই মৃত্যু যেন ক্ষণিক স্তব্ধ হয় যতক্ষণে না আমি হাজারো চুমুর শেষ চুমুটি তোমার ঠোঁটে এঁকে দিচ্ছি।’ মৃত্যু স্তব্ধ হয়নি শেষ পর্যন্ত কর্তব্যে অবহেলার জন্য রোমের অধিপতি অক্টোভিওর বিচারে প্রাণদন্ড- হয় এ্যান্টোনির, ক্লিওপেট্রা নিজেই হনন করেন নিজেকে। আর রোমানদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সত্যিই মৃত্যু হয় প্রাচীন মিসরের। এ কাহিনী প্রাচীন মিসরের একেবারে শেষ অধ্যায়ের। আমরা চাই শুরু থেকে দেখতে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় আলো ফেলে। বাইরাইনের রুচিস্নিগ্ধ লাউঞ্জে মনোরম একটি বিকেলের স্মৃতি পেরিয়ে কায়রোগামী দ্বিতীয় ফ্লাইটের দিকে এগোই। ॥ দুই ॥ বাইরের সিঁড়ির ল্যান্ডিং যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু ভেতরে যাওয়ার পথ। কয়েক পা এগিয়ে মূল দরজায় প্রহরী বসে। মোবাইল ফোন, ক্যামেরা, ব্যাগ ইত্যাদি রাখতে হবে তার জিম্মায়। ভেতরে প্রবেশ ঝাড়া হাত-পা। ঢুকেই টের পাই এসব রেখে যাওয়ার অপরিহার্যতা। হামাগুড়ি দেয়ার মতো কুঁজো হয়ে উঠতে হবে ওপরে। ছোট ছোট সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে। বিশাল বপুরা রণেভঙ্গ দেন শুরুতেই। দৈর্ঘ্যে যারা বেশি তাদেরও সমস্যা। শরীরকে এতটা ভাঁজ করে ওপরে ওঠানো কঠিন। অনেকের নাকি শ্বাস কষ্ট ধরনের সমস্যা হয়। গাইড বলেছে সমস্যা হলে ফিরে আসবে। কত দুর্গম দর্শনীয় জয় করে এলাম! বাড়ির পাশের চেরাপুঞ্জি আর পোখারার পাহাড়ের প্রাচীন গুহাসুরঙ্গ থেকে শুরু করে রক্ত হিম করা আইফেল টাওয়ারের চূড়া, হিল ট্রেনে সুইজারল্যান্ডের পর্বতের খাড়া বেয়ে নামা, আন্দামানে উত্তাল ঢেউয়ে সমুদ্র পাড়ি দেয়া। আর এত আজন্ম বিস্ময় প্রাচীন সপ্তার্যের অন্যতম মিসরের খুফুর পিরামিড। শ্বাসকষ্টের ভয় কি আমাদের ফেরাতে পারে! ॥ তিন ॥ ঢুকে পড়েছি খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার নয়শ’ সালে। কায়রো থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে গিজার গ্রেট পিরামিডে। এখানেই ছিল ফারাও খুফুর মমি। খুফু নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে ‘খুফুর পিরামিড’ নামেও এর পরিচিতি রয়েছে। মানুষের অমরত্বের আকাক্সক্ষা চিরন্তন। তা যে কি তীব্র বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল প্রাচীন মিসরীয়দের কাছে তারই মূর্ত প্রকাশ পিরামিড। মিসরীয়রা বিশ্বাস করত নীল নদের পাড়ে যেমন এই পৃথিবী তেমনি নীল আকাশেও আছে এ রকম আরেকটি পৃথিবী। সেটি মৃত্যুর পরের। মৃত্যুর পরের ওই জীবন এ জীবনেরই সম্প্রসারণ। ওখানেও আছে খিদে-পিপাসা, ঘুম-জাগরণ, এখানকার মতো অন্যসব জরুরী বিষয়। ওই জীবনে পৌঁছতে হলে শরীর রাখা চাই অক্ষত। পচা-গলা শরীর ওখানে যাওয়ার অনুপযোগী। শরীর যতদিন অক্ষত অমরত্বও ততদিনের। পিরামিড যুগে ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল এমনই। মৃতদেহ মমি করে রাখা তাই সে সময় ছিল সাধারণ ধর্র্মীয় রেওয়াজ। সংরক্ষণের সঙ্গতি অনুযায়ী স্থায়িত্ব পেত মমি। সে অনুযায়ী অমরত্ব। শাসক এবং ক্ষমতার শীর্ষ ফারাওদের অমরত্বের আকাক্সক্ষাও ছিল শীর্ষ স্পর্শী। দেহ সংরক্ষণের জন্য তাই তারা বানিয়েছিল পিরামিড। এর নির্মাণশৈলীই এমন যে, এখানে রাখলে কোন দিন ক্ষয় হয় না শরীর। অসাধারণ জ্যামিতিক এবং গাণিতিক জ্ঞানের সমন্বিত রূপ পিরামিড। সেই প্রাচীনকালে এত জ্ঞান এরা অর্জন করেছিল কি করে ভাবলে বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয়। ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়ামে এখনও সংরক্ষিত আছে ফারাও তুতেনখামেনের মমি। সত্যিকারের চামড়া, সত্যিকারের দাঁত-মুখ, কপাল, চোখের কোটর দুটো কালো কাপড়ে বাঁধা। গা শিউরে ওঠে! কত হাজার বছর আগের একটি মানুষের শরীর! ভাস্কর্য নয়, আলোকচিত্র নয়, পেইন্টিং নয় একেবারে সত্যিকারের দেহ! অমরই তো হয়েছে আসলে। এত কাল পরের মানুষ আজকের আমরা দেখছি- এককালের ক্ষমতাবান, প্রতাপশালী সত্যিকারের ফারাওকে। এত অমরত্বই। অপূর্ব কারুকাজের তিনটি বিশাল আকৃতির কফিন সাজানো রয়েছে মিউজিয়ামের তিনটি ঘরে। ওতে তুতেন খামেনের দেহ ছাড়াও মূল্যবান রত্ন সহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস রাখা ছিল। একজন রাজার জীবনযাপনের জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই। একটি আলোকচিত্রও আছে সে সবের। কফিন উদ্ধার করেছে যারা তাদের তোলা। ॥ চার ॥ পিরামিডের ভেতরে এখন দেখার তেমন কিছু নেই। সিঁড়ি বেয়ে আমরা যেখানে উঠলাম সেটা টপ ফ্লোর। এর ওপর আর কিছু নেই। পাথরের তৈরি বুক সমান উঁচু খোলা আয়তাকার একটি কফিনের মতো জিনিস। হয়ত মমি বানানোর প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হতো। অথবা অন্য কিছু। সেলফোন, ক্যামেরা নেয়া নিষেধ হলেও একটি ফোন আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে দেখি আরও দু’য়েকজনের হাতেও আছে। ছবি তুলছে। বুঝলাম কড়াকড়িটা আসলে বজ্র আঁটুনি ফস্কাগেরো। অন্তত সেলফোনের বেলায়। ওপরে উঠতে এটা প্রতিবন্ধকতাও তৈরি করে না। নিজেরা নিজেদের ছবি তুলছি। হঠাৎ হিন্দীতে কথা বলে এগিয়ে এলো পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক তরুণ। ভারত থেকে এসেছে। ভেবেছিল আমরাও ভারতীয়। আমাদের কিছু গ্রুপ ছবি তুলে দিল। জাতিগত বৈশিষ্ট্যের সিল-ছাপ্পড় আমাদের চেহারায় এত প্রকট যে স্থানীয় লোকজন ধরেই নিয়েছে আমরা ভারতীয়। ‘ইন্ডিয়ান’ ‘এই ইন্ডিয়ান।’ ‘ইন্ডিয়া-শাহরুখ খান’, ‘ইন্ডিয়া-কারিনা কাপুর’। ‘ইন্ডিয়া-অমিতাভ বচ্চন’। এ শব্দগুলো শোনা ওই ক’দিনে আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। টিজ নয়, মজা পেত ওরা। মনে হয় খুশিই হতো। ভারতীয় হিন্দী সিনেমার নায়ক নায়িকারা এত প্রিয় যে সে দেশ থেকে আগতদের দেখলে ওদের ভাল লাগে। এমন কি গব্বর সিংয়ের নামও জানে। আমাদের দেশের অনেকেও যা জানে না। হিন্দী সিনেমার কারবারিরা মিসরেও ‘কামাল’ করে দিয়েছে। অবাক কান্ড ! তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি কায়রোর মার্কেটে গিয়ে। একটি আউটলেটের সামনে দাঁড়াতেই প্রায় মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক হেসে অভ্যর্থনা জানায় ‘ফ্রম ইন্ডিয়া, রাইট? আমরাও হেসে উত্তর দেই ‘নো, বাংলাদেশ। ‘ও, বাংলাদেশ! তসলিমা নাসরিন’! বিশাল আবিষ্কারে উল্লসিত সে। পিরামিড দেখার মতোই বিস্মিত হই অনেকটা। এখানে এভাবে তসলিমা নাসরিনের নাম শুনব কল্পনাও করিনি। কে যে কিভাবে দেশকে ব্র্যান্ডিং করে! ভদ্রলোকের সম্ভবত কবি-সাহিত্যিক মহলে যোগাযোগ আছে। অথবা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তসলিমাকে নিয়ে কোন ফিচার বা নিবন্ধ পড়েছেন। তাছাড়া কীভাবে তসলিমার নাম জানলেন ভেবে পেলাম না। যা হোক, সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেখানে দাঁড়ালাম সেখান থেকে আরেকটি সিঁড়ি সম্ভবত নেমে গেছে নিচের দিকে। পিরামিডের মাঝ বরাবর। ওখানেই রাজা খুফুর ঘর। রানীর ঘর। গ্র্যান্ড গ্যালারি বা বড় হলরুম। মাটির নিচে আছে আরেকটি ঘর। সবই এখন বন্ধ। পর্যটকদের জন্য খোলা শুধু ওপরেরটুকু। প্রতিটি পিরামিডের সঙ্গে লাগোয়া একটি করে মন্দির। সেখানে রাজার জন্য পোশাক, মূল্যবান রত্ন অস্ত্র অলঙ্কার সোনা-রুপার পাত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস, খাবার পানীয় ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে রাখা হতো। মৃত্যুর পরেও যাতে তিনি রাজকীয় জীবনযাপন করতে পারেন। ভেতর থেকে একটি কৃত্রিম দরজাও ছিল। যাতে রাজা মন্দিরে বেরোতে পারেন। রানীর গায়ে থাকত মূল্যবান রত্নের অলঙ্কার। সামন্ত যুগের কোন এক রাজকন্যার মাথায় পরানো ছিল সোনার ফুলে গাঁথা রত্নের সিঁথিপাটি বা টায়রা। যা শুধু মূল্যবানই নয় মিসরীয় কারিগরি শিল্পের চরম উৎকর্ষেরও প্রমাণ। বলেছিল গাইড। সুমেরীয়রা মৃত রাজা-রানীর সঙ্গে তাদের দাস-দাসীদেরও জীবিত সমাধি দিত তাদের সেবা করার জন্য। মিসরে এ নির্মম প্রথার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য নেই। তারা পিরামিডের ভেতরে দাস-দাসী ও অনুচরদের দেয়ালচিত্র এঁকে দিত। সেই সঙ্গে হায়রোগ্লাইফিক লিপিতে শিরোনামসহ রাজাদের জীবনবৃত্তান্ত ও সাফল্যের গুণগানের সার বাঁধা রঙিন চিত্র। চিত্র বা প্রতীক ব্যবহার করে বক্তব্য প্রকাশের বিশেষ রীতির নাম হায়রোগ্লাইফিক। মিসরীয়রা যা আবিষ্কার করেছিল। যেমন হোটেল রেস্তরাঁয় আজকাল আমরা দেখি নারী-পুরুষের আলাদা টয়লেট বোঝাতে নারী এবং পুরুষের আলাদা প্রতীক ব্যবহার করা হয়Ñ অনেকটা সে রকম। প্রতীকটির পোশাক, শারীরিক গঠন ইত্যাদি দেখেই আমরা বুঝি একটির মানে পুরুষ অন্যটির মানে নারী। ওড়া অর্থে হয়ত পাখি বোঝাত, ভাসা অর্থে হাঁস- এ রকম আর কি। ‘রোজেটা’ পাথরের এই হায়রোগ্লাইফিক লিপির পাঠোদ্ধারের পরই এ যুগের মানুষের কাছে উদ্ঘাটিত হয় প্রাচীন মিসরের ইতিহাস। বেরিয়ে আসে জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতির একটি আলোকিত ধারা। বিশেষজ্ঞরা যার নাম দিয়েছেন ‘ইজিপ্টোলজি’ বা ‘মিসরতত্ত্ব।’ ফরাসী ভাষা বিজ্ঞানী সাঁপোলীয় যার সন্ধান দিয়েছেন এই সেদিন- মাত্র দু’শ’ বছর আগে। এর আগে পিরামিড এবং অন্যান্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের ইঙ্গিত দিয়েছে কিন্তু এ সবের গায়ে লেখাগুলো পড়তে পারার পরই সে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা জানতে পেরেছে মানুষ। মিসরে তিন ধরনের ভাষার প্রচলন হয়েছিল। হায়রোগ্লাইফিক, হায়রেটিক ও ডিমোটিক। হায়রোগ্লাইফিক ছিল মূলত দেবভাষা। দেবতা বা রাজাকে খুঁশি করার জন্য এ ভাষায় প্রশস্তি লিখত পুরোহিতরা। বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে দেবতার উপদেশ হিসেবে এখনও জ্বল জ্বল করছে হায়রোগ্লাইফিক লিপিমালা। ‘প্যাপিরাস’ থেকে যে পেপারের উৎপত্তি তারও জন্ম মিসরে। নলখাগড়ার মতো এ জলজ উদ্ভিদ। থেঁতলে রোদে শুকিয়ে কাগজ বানাতে শিখেছিল তারা। যাতে গোপন তথ্য, তন্ত্রমন্ত্র, ওষধের ফর্মুলা বা রাজকীয় দলিল, হিসাব-নিকাশ লিখে মুড়ে রাখা যায়। সাঙ্কেতিক চিহ্নে লেখা হতো এগুলো। যেন সবাই বুঝতে না পারে। প্যাপিরাস পেপার বানানোর প্রক্রিয়া দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে অনেক স্যুভেনির শপ বা গ্যালারিতে চমৎকার হলদেটে পুরু এক ধরনের কাগজ। পুরোটা প্রাকৃতিক। কাগজ ছাড়াও ও প্যাপিরাস দিয়ে পাটি, দড়ি, স্যান্ডেল ইত্যাদিও নাকি বানাত মিসরীয় কারিগররা। কারিগরি কাজ বা ব্যবসা ছিল বংশানুক্রমিক। সে অনুযায়ী সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস হয়েছিল। অনেকটা প্রাচীন ভারতের মতো। পিরামিডের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার মুখে ইশরায় থামায় গার্ড। প্রথমে চমকে উঠি কোন ভুল হয়নি তো! না মুহূর্তে বুঝে যাই। হাত থেকে সেলফোন নিয়ে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় দাঁড়াতে বলে। আমাদের ছবি তুলে দেবে। ভিউপয়েন্ট ভালই জানা আছে তার। ছবিগুলো ভাল হয়েছে। স্বেচ্ছা সেবক হয়ে এ কাজ করলেও দ্বিতীয় দিনের অভিজ্ঞতায় জেনেছি বখশিশ দিতে হবে তাকে। মিসরে এই এক বিরক্তিকর অনুক্ত আবদার-বখশিশ। ড্রাইভার গাইড থেকে শুরু করে কেউ কিছু করে দিলেই বখশিশ দিতে হবে। না হলে মুখ ভার। তবে একে খুশি মনে বখশিষ দেয়াই যায়। কেননা পিরামিডের ভেতরের ছবি তো আর প্রতিদিন তোলা হয় না। ড্রাইভার, গাইড কে তো দিয়েই যাচ্ছি, এ দুজনকে খুশি না রাখলে দেখাটাই হয়তো ঠিকঠাক হবে না। তবে গাইড আবির হাম্মাদ পেশাটা ভালই রপ্ত করেছে। তার পড়াশোনা বিষয়ই ‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ট্যুরিজম গাইডেন্স’। তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে বয়স হবে। চটপটে। আকর্ষণীয় ভাবে তথ্য উপস্থাপনের আধুনিক শৈলিতে ঝলমলে। আবিরের তত্ত্বাবধানে এবার দেখবো পিরামিডের বাইরের দিক। ॥ পাঁচ ॥ মিসর বলতেই যে পিরামিডের চিত্র মনে আসে বা ‘গিজার’ পিরামিড বলে পরিচিত যে পিরামিড বিশ্বখ্যাত তা নির্মিত হয়েছে প্রাচীন মিসরের ইতিহাস শুরুর পাঁচ শ’ বছর পর। মিসরের সবচেয়ে পুরনো লিখিত বিবরণ পাওয়া খ্রিস্টজন্মের তিন হাজার চার শ’ বছর আগে। ইতিহাসের শুরু সেই থেকে। দজলা ফোরাত এবং সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল প্রায় একই সময়। বা কিছু পরে। কিন্তু কোথাও পিরামিডের মতো চির বিস্ময়কর নেই। যুগ যুগ ধরে কত কল্পকথা চালু হয়েছে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অক্ষত এ স্থাপনা নিয়ে! কিশোর বয়সে পড়া সেই ‘আন আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং সসা’র-এ করে ভিনগ্রহ থেকে মানুষ এসে পিরামিড নির্মাণের কল্পকাহিনী তো এখনও মনে গাঁথা। সত্যি এ বিশাল স্থাপনার সামনে দাঁড়ালে অনেক কল্পকাহিনী ডালপালা মেলা স্বাভাবিক। গ্রেট পিরামিডই তেরো একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে। খুফুর বংশধর খুফরুর পিরামিডটি খুফুর চেয়ে আয়তনে ছোট হলেও বিখ্যাত সেই ‘স্ফিংস’-এর জন্য এর বিশেষ আকর্ষণ। পাহাড় কেটে তৈরি এক বিশাল সিংহ। মুখটি ফারাও খুফরুর। অপরূপ তার ভঙ্গি। অটোম্যান অভিযানের সময় কামানের আঘাতে নাক ভেঙ্গেছে। তাতে সৌন্দর্যহানি খানিক হলেও বিশালতা খর্ব হয়নি একটুও। অপূর্ব। অনবদ্য। বিস্ময়কর! এমনভাবে করা হয়েছে মনে হয়, পিরামিডের সামনে বসে আছে এক পরাক্রমশালী সিংহ-মানব। যেন পাহারা দিচ্ছে বিশাল এ স্থাপনা। ছোটটির নির্মাতা রাজা মেনকর কায়রো থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার দূরে ধু-ধু মরুভূমির মধ্যে এ পিরামিড চত্বর শুধু প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য নয়, যতদিন টিকে থাকবে ততদিনই পৃথিবীর মানুষের কাছে মহাবিস্ময় হয়ে থাকবে। প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের কলোসিয়াম, পিসার হেলানো মন্দির, আর আগ্রার তাজমহল দেখা হয়েছে আমাদের। কিন্তু পিরামিডের সঙ্গে কোনটারই তুলনা হয়না। ধাতুর আবিষ্কার ও ব্যবহার মিশরীয়রা করলেও চাকার আবিষ্কার তখনও হয়নি। সে সময় আড়াই টন ওজনের একেকটি পাথরের টুকরোইবা কি করে দূর থেকে বয়ে আনা হয়েছিল আর অতো ওপরেই বা ওঠানো হয়েছিল কি করে সেও এক মহা বিস্ময়। চুয়ান্ন টন ওজনের পাথর ব্যবহার করা হয়েছে খুফুর পিরামিডে, খুফুর ঘরের ছাদে। পাহাড় কেটে পাথর বয়ে এনে একটি একটি করে গেঁথে এ বিশাল কর্মযজ্ঞের পুরোটা সম্পন্ন হয়েছিল মানুষের শ্রমে। কোন মেশিনের সাহায্যে নয়। বিস্ময়! কেবলই বিস্ময়! প্রায় একশ একর এলাকা জুড়ে এ সমাধি প্রান্তরের কাছেই ছিল রাজ প্রাসাদ, বাগানবাড়ি, শান বাধানো ঘাট ইত্যাদি। যা এখন কেবলই ধুলো। কিন্তু পাথরে নির্মিত পিরামিডগুলো ফারাওদের অমরতা লাভের আকাক্সক্ষার অক্ষয় কীর্তি হয়ে আজও টিকে আছে।
×