ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শরীয়তপুরের একজন সফল স্কুলশিক্ষিকা

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ১৮ আগস্ট ২০১৭

শরীয়তপুরের একজন সফল স্কুলশিক্ষিকা

বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারায় নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ যেভাবে সার্বিক উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে একইভাবে নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে সমাজ সংস্কারে সফল ভূমিকা রাখারও দাবিদার। ক্ষুদ্রতর পারিবারিক সীমানাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে নারীদের সক্রিয় কর্মযোগ দেশের ও জাতির জন্য বিশেষ শুভ সঙ্কেত। এক সময় নারীরা সাংসারিক জীবন সুষ্ঠুভাবে সামলাতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও পরিবারের বাইরে নিজের জন্য কিছু করার ভাবনা সেভাবে আসত না। যুগ পাল্টেছে, সময়ের চাকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, নিজেকে যথার্থভাবে প্রমাণ করার তাগিদও সামনে এসে যাচ্ছে। সর্বোপরি নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বারও মানুষের এখন হাতের নাগালে। সরকারী এবং বেসরকারী কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় দিগন্ত উন্মোচন হওয়া যেমন সামগ্রিক সমৃদ্ধির নিয়ামক একইভাবে ব্যক্তি মানুষের সফল কর্মযোগে নিজেকে তৈরি করার সুযোগও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আর এরই সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে নারীদের ঘর থেকে বাইরে পা দেয়ার বিষয়টি। কিছুদিন আগেও কর্মসংস্থানের সুযোগ এতই অপ্রতুল ছিল যে মেয়েরা ইচ্ছা করলেও তেমন কোন সম্মানজনক পেশা সেভাবে পেত না। কিন্তু এখন দেশের সেই দুঃসময় আর নেই। সমাজ ব্যবস্থা ও প্রগতির ধারায় পুরনো বিধি নিয়মকে অতিক্রম করে সামনের দিকে নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছে। আর দেশের এই সুফলের অংশীদার হচ্ছে নারীরাও। শুধু বিভাগীয় শহরগুলোতেই নয়, গ্রাম-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নারীরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে বিভিন্ন সম্মাজনক পেশায় নিজেদের যুক্ত করেছে। এক সময় মনে করা হতো শিক্ষকতাই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পেশা। অন্যান্য পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনও শিক্ষকতাকেই সিংহভাগ মেয়ে বেছে নেয়। এমনই এক শিক্ষিত আফসানা আলতাফ শিখা। শরীয়তপুরের তেঁতুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি গত আট বছর ধরে ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে আসছেন। এমন পছন্দের পেশায় তিনি এতই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন যে সারাদিন স্কুল করার পরও ক্লান্তি আর অবসাদে বিব্রত হতে হয় না। আফসানা আলতাফ ১৯৭৮ সালে টাঙ্গাইল গার্লস স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। নিয়মমাফিক ১৯৮০ সালে তিনি টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৩ সালে পছন্দের মানুষ শরীয়তপুরের মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন শিকদারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর পরই কোন পেশায় সেভাবে নিজেকে জড়াতে পারেননি। বলেছেন এই দায়ভাগ তার নিজের। কারণ স্বামী আধুনিক এবং উচ্চ শিক্ষিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়া। তার পক্ষ থেকে কখনও কোন বাধা ছিল না। ইতোমধ্যে প্রথম সন্তান হুমায়ুন কবির প্রিন্সের জন্ম। মাতৃত্বের মহিমায় জীবন তখন কানায় কানায় পূর্ণ। সন্তানকে বড় করার অনাবিল আনন্দ আর প্রবল ইচ্ছায় নিজের দিকে তাকানোর সময়ই ছিল না। দুই বছর পরে কন্যা বন্যার জন্ম। মায়ের স্নেহে, মাতৃছায়ায় ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার দায়বোধ থেকেই সংসারেই নিজেকে নিমগ্ন রাখলেন। কিন্তু সন্তানরা যখন বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করল তখন থেকে তিনিও ভাবলেন একটা কিছু করা দরকার। যেই ভাবা অমনি লেগে পড়া। ১৯৯৩ সালে নাজিমপুর সরকারী প্রাইমারী বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। মাত্র ৮ মাস সেখানে কাজ করার পর শরীয়তপুর সদরে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। যেহেতু সরকারী চাকরি সে কারণে বদলি হওয়ার সুযোগ এবং বিড়ম্বনা দুটোই থাকে। তার বেলায়ও এর অন্যথা হয়নি। এখানেও দুই বছর থাকার পর অন্যত্র বদলি হয়ে যেতে হয়। ততদিনে পিটিআই প্রশিক্ষণ ডিগ্রীও নেয়া হয়ে যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তাকে শিক্ষকতার কিছু সময় কাটাতে হয়েছে। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তিনি তার পেশাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে মানিয়ে নিতে পেরেছেন। ছেলে প্রিন্স জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানি বেক্সিমকোতে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কর্মরত আছে। মেয়ে বন্যাও স্নাতক ডিগ্রী শেষ করে সংসার ধর্ম পালন করছে। এতদূর পথ পাড়ি দিতে স্বামীর সর্বক্ষণিক সহযোগিতা তার এগিয়ে যাওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করেছে। স্বামীর কাছ থেকে সব ধরনের অধিকার এবং স্বাধীনতা পেয়েছেন। স্বামী ব্যবসায়ী। যখন তিনি চাকরি করতেন না সে সময়ও স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা শ্রদ্ধাভরে স্বীকার করেছেন। এখন তো তিনি স্বাবলম্বী। তার পরেও নিজের আয় এবং স্বামীর আয় দুটোই তিনিই এক হাতে এখনও সামলান। সাংসারিক এবং ছেলেমেয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তাদের দু’জনেরই সমান। কর্তৃত্বের কাঠামোতেও স্বামী-স্ত্রীর কোন ফারাক নেই। এটা দেশের জন্য একটি শুভ সঙ্কেত। এত নারী নির্যাতন আর নিগ্রহের ঘটনা ঘটে তাতে মনে হয় মেয়েরা একেবারে বর্বর যুগে বাস করছে। এসব কিছু ব্যতিক্রমী সামাজিক চেহারা আমাদের আশ্বস্ত করে। সম্ভাবনা জাগায়। মনে হয় আমরা সত্যিই সামনের দিকে এগুচ্ছি। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×