ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

বঙ্গবন্ধুর খুনীর পাশেই বাস করতে হচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৫ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধুর খুনীর পাশেই বাস করতে হচ্ছে!

পনেরোই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। এই দিনে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই, ব্যক্তিগতভাবেও দিবসটির কথা ভাবলে আজও গা শিহরে ওঠে। যিনি সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন বাঙালী জাতির নিজস্ব আবাসভূমির জন্য, তাকেই সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কিছু নরপিশাচ। যা পারেনি সারাবিশ্ব, যা করতে সাহস পায়নি খোদ পাকিস্তান, তাই করেছে এই দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার। এটাই বাঙালী জাতির দুর্ভাগ্য যে, সেই সিরাজ-উদ-দৌলার সময় থেকেই প্রতিটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু বেইমান ও বিশ্বাসঘাতক এবং ভবিষ্যতেও হয়ত থাকবে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তথা সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান আততায়ীর হাতে নিহত তা হবার ঘটনা পৃথিবীতে অনেক আছে। আব্রাহাম লিংকন থেকে ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত অনেক সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কিনা আমার জানা নেই। শুধু তাই নয়, হত্যাকারীরা পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করেছে সমাজে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায়। তারা দম্ভোক্তি করে প্রকাশ্যে বলে বেড়াত যে, তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তাদের বিচার করা যায়নি দীর্ঘদিন। সেইসব খুনী এবং তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের দৌরাত্ম্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজের সর্বস্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। আশির দশকে আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অবস্থা এমন তৈরি করা হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার তো সুদূর পরাহত, বঙ্গবন্ধুর নামও নেয়া যেত না। আজ আমাদের অনেকেই যে প্রবাস জীবন বেছে নিয়েছি, তারও অনেক কারণের মধ্যে একটি ছিল সেই সময়ের প্রতিকূল অবস্থা। যাহোক অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে অবশেষে সত্যের জয় হয়েছে। স্বঘোষিত হত্যাকারীদের বিচার বাংলার মাটিতে হয়েছে এবং সেই সঙ্গে থেমে গেছে নরপিশাচদের দৌরাত্ম্য ও আস্ফালন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। যেসব হত্যাকারী সাহস করে দেশে ছিল এবং যাদের সরকার আটক করতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের সাজা কার্যকর করা হয়েছে। তবে পরিণতি বুঝতে পেরে বেশ কয়েকজন হত্যাকারী রাতের অন্ধকারে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে তাদের দণ্ড কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি। পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আত্মস্বীকৃত খুনীদের একজন নূর চৌধুরী। সে পালিয়ে কানাডা এসে এই টরনটো শহরে বাস করছে। এক সময়ের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত দাম্ভিক খুনী এখানে এসে বাঁচার তাগিদে সবকিছু অস্বীকার করে আদালতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলেও আদালত তার ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করেই তার আবেদন নাকচ করে দেয় বলে জেনেছি। তার কানাডা থাকার কোন আইনগত ভিত্তি না থাকলেও সে বহাল তবিয়তে এই টরনটো শহরের বিলাসবহুল এপার্টমেন্টে বাস করছে। আমাদের ট্যাক্সের টাকাতেই চলছে একজন স্বঘোষিত এবং একটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত খুনীর ভরণপোষণ। কানাডা সরকারের এমন সিদ্ধান্তে এখানকার সাধারণ মানুষের সায় আছে বলে মনে হয় না। আমি আমার সহকর্মীসহ এখানকার স্থানীয় পরিচিত সকল নাগরিকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। তারাও কথাটা শুনে হতবাক হয়েছেন এবং বিশ্বাস করতে চান না যে, এমনটা এখানে ঘটতে পারে। সত্যি বলতে কি কানাডা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর একটি দেশ। বিশেষ করে মানবাধিকার, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো, বাক স্বাধীনতা, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার, বহুসংস্কৃতির চর্চা, নাগরিকদের চার্টার অব রাইট এর মতো বিষয়ে কানাডার অবস্থান বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে অনেক ওপরে। এরপরও এ সকল মানবিক গুণাবলী এবং মূল্যবোধের অপব্যবহার করে এমন দুএকটি ঘটনা ঘটে যা বিবেকবান মানুষকে হতবাক করে দেয়। এতে কানাডিয়ানদের লজ্জিত ও বিব্রত হতে হয়। যেমন মাত্র কিছুদিন আগে কানাডার বর্তমান সরকার এক কানাডীয় নাগরিক ও তালেবান সদস্য ওমর খাদিরকে প্রায় দশ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে তার দায়ের করা এক মামলা আদালতের বাইরে (আউট অব কোর্ট) নিষ্পত্তি করে। ওমর খাদির তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে তালেবানে যোগদান করে আফগানিস্তানে চলে যায় এবং সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাস বিরোধী যৌথবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধে তার বাবা ও ভাই নিহত হলেও সে গ্রেনেড হামলা করে যুক্তরাষ্ট্রের এক সৈন্যকে হত্যা করে যৌথবাহিনীর হাতে আটক হয়। যুক্তরাষ্ট্র সেই ওমর খাদিরকে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করে এবং বিচার শুরুর পূর্বে তাকে কিছুদিন বিতর্কিত নির্যাতন সেল গুয়ানতানামো বেতে রেখেছিল। নির্যাতন ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় একজন কানাডীয় নাগরিক হিসেবে এখানকার চার্টার অব রাইট অনুযায়ী কানাডা সরকারের কাছ থেকে যে আচরণ পাওয়ার কথা তা সে পায়নি। যাহোক বিচারে সেই ওমর খাদির আদালতে ইউএস সৈন্য হত্যা করার ঘটনা স্বীকার করে এবং বিচারের রায়ে তার কারাদণ্ড হয়। তার দণ্ডের অবশিষ্ট সাজা সে কানাডার জেলে খাটবে মনে করে সরকার তাকে কানাডা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এসেই সে কানাডার সরকারের বিরুদ্ধে চার্টার অব রাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে আদালতে মামলা দায়ের করে, যা নিষ্পত্তি করার জন্য সরকারকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হয় একজন আত্মস্বীকৃত এবং আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীকে। উল্লেখ্য আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে যৌথবাহিনী সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত ছিল, সেখানে কানাডার সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিল এবং সেই সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে কানাডার প্রায় দেড় শত সৈন্য এরকম ওমর খাদিরের মতো তালেবান সদস্যদের হামলায় নিহত হয়েছে। এরকম একজন আত্মস্বীকৃত তালেবান সন্ত্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যকে হত্যা করেছিল এবং সুযোগ পেলে সে কানাডীয় সৈন্যকেও হত্যা করত, তাকেই কিনা প্রায় দশ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাতারাতি বড়লোক বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এরকম ঘটনায় সাধারণ মানুষের আদৌ কোন সায় নেই। তারপরও সরকার কাজটা করেছে, যেমনটা তারা করেছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী নূর চৌধুরীকে এখানে রাখার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে খুনী নুর চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজে এসে কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং আশা করেছিলেন যে, তিনি হয়ত খুনী নুর চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন। কেননা প্রধানমন্ত্রীর বাবা পিয়েরে ট্রুডো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোন এক রহস্যময় কারণে খুনী নুর চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কানাডা সরকার কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। আসলে শুধুমাত্র সরকারী প্রচেষ্টায় এই ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন এখানে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ। এখানে স্বাধীনতার সপক্ষের অসংখ্য বাংলাদেশী বসবাস করে এবং তাদের মধ্য থেকে ছোটখাট উদ্যোগ মাঝেমধ্যে যে গৃহীত হয় না এমন নয়। স্থানীয়ভাবে সভা, মানববন্ধন এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ করে সরকারের নিকট প্রেরণ করার মতো কিছু উদ্যোগ আগেও লক্ষ্য করা গেছে এবং এখনও যায়। তবে সেগুলো সরকারের যথাস্থানে পৌঁছায় কিনা বা পৌঁছালেও এ ব্যাপারে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে কিনা, সেটা নিয়ে সংশয় আছে। এখন সময় এসেছে এখানে বাস করে দেশের বিভাজনের রাজনীতির চর্চা না করে এখানকার মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নীতিনির্ধারণী মহলের সান্নিধ্যে যাবার। তাহলে খুনী নুর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে যেমন ভূমিকা রাখা যাবে, ঠিক তেমনি নিজেদের কমিউনিটির উন্নতির ক্ষেত্রেও অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে। কয়েক মাস আগে এখানকার বৃহৎ এক রাজনৈতিক দলের কনভেনশনে যাওয়া এবং একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে ছোটখাট একটা দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয়েছিল। আমার ধারণা ছিল যে, উপস্থিত কয়েক হাজার সদস্যের মাঝে বেশকিছু বাংলাদেশীকে দেখতে পাব। কিন্তু তেমন কাউকেই না দেখে একটু হতাশ হয়েছি। যতটুকু খোঁজার চেষ্টা করেছি তাতে একজন বাংলাদেশীরও সাক্ষাত পাইনি। সেই দলের অনেক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী এবং আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত নুর চৌধুরীর এখানে এভাবে অবৈধভাবে বসবাস করা এবং তাকে বাংলাদেশ ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তারাও শুনে হতবাক এবং এমনটা হওয়া উচিত নয়, এখানে এভাবে থাকতে পারে না ইত্যাদি নানা কথা বলে এক ধরনের আশার বাণী শোনালেন। তবে পরিশেষে এও বললেন যে, এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোচনা করে তেমন কিছু হবে না। বরং স্থানীয়ভাবে বিষয়টি উত্থাপন করে দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করা গেলে একটি পথ খুলে যেতে পারে। বিষয়টি কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশীরা ভেবে দেখবেন এবং সেইসঙ্গে এখানকার মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শুরু করবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কেননা এখানে বাস করে দেশের রাজনীতি চর্চা করে কোন লাভ হবে না। বরং এখানকার রাজনীতি সঠিকভাবে করতে পারলেই যথেষ্ট লাভ আছে। আর এই সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অবদান রাখতে সক্ষম হব, যেমনটা আমাদের পার্শ্ববর্তী অনেক দেশের জনগণ করছে। তা নাহলে আমাদের এখানে ছাপোষা হয়েই থাকতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এবং সেইসঙ্গে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুর খুনীও থাকবে আমাদের পাশেই। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা [email protected]
×