ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. হারুন-অর-রশিদ

মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৫ আগস্ট ২০১৭

মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু

১৫ আগস্ট বাঙালীর ইতিহাসে সবচেয়ে শোকাবহ দিনÑ ‘জাতীয় শোক দিবস’। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী-বিদেশী মহলের ষড়যন্ত্রে একদল ঘৃণ্য ঘাতক-খুনী কর্তৃক ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সংঘটিত হয় মানবজাতির ইতিহাসের এক চরম, নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক হত্যাকা-। এর নির্মম শিকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘাতকের নিষ্ঠুর বুলেট বিদীর্ণ করে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দেহও। নিষ্পাপ শিশু রাসেলসহ রেহাই পাননি বঙ্গবন্ধু পরিবারের উপস্থিত কোন সদস্যই। বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা। সেদিন ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়ক দিয়ে প্রবাহিত রক্তস্রোতে যেন বাংলায় সৃষ্টি হয় নতুন এক লোহিত সাগর। বাঙালীর জীবনে রচিত হয় ‘গ্রিক ট্র্যাজেডি’র আরেক উপাখ্যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর জনগণের সার্বিক কল্যাণে বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল উৎসর্গীকৃত। এ প্রশ্নে অন্য সবকিছু ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর একটি একান্ত সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিলেন। এটি একটি মূল্যবান দলিল। এ থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবন-আদর্শ সম্বন্ধে অনেক স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন তাঁর সেলের পাশের্^ কবর খনন করা হয়, তখন তাঁর মনের অবস্থা কিরূপ হয়েছিল বা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কথা মনে হয়েছিল কি-না, ডেভিড ফ্রস্টের এই প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, ‘আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখভোগ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা (সাধারণ মানুষ) কী গভীরভাবে ভালবাসে।’ অপর এক প্রশ্নে ফ্রস্ট যখন জানতে চাইলেন, কোন দিনটিকে বঙ্গবন্ধু জীবনের ‘সবচাইতে সুখের দিন’ বলে গণ্য করেন। কোনরূপ চিন্তা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যেদিন শুনলাম, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনটিই ছিল আমার জীবনের সবচাইতে সুখের দিন।’ বাঙালী জাতির স্বাধীনতা ও সার্বিক মুক্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, নিজের জন্মদিন পর্যন্ত তিনি কোনদিন পালন করেননি। শোষিত-নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালীর একজন হিসেবে তিনি সব সময় নিজেকে দেখেছেন এবং বাঙালী জাতির মুক্তির মধ্যেই নিহিত ছিল তাঁর জন্মদিনের আনন্দ। তাই কারাবন্দী থাকাবস্থায় ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ তাঁর ৪৭তম জন্মবার্ষিকীর দিনে বঙ্গবন্ধু তাঁর দিনপঞ্জিতে লেখেন, ‘আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনদিন নিজে পালন করি নাই... খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দী আছি বলেই। আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস! দেখে হাসলাম’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০৯)। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ এক বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর নিকট তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন প্রসঙ্গ তুললে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘দেখেছেন তো, চতুর্দিকে আমার মানুষ কী অসহায়, তাদের কত যন্ত্রণাবোধ, আমার জন্মদিন- বা কী মৃত্যুদিন- বা কী।’ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ১৯৬৮ সালের মধ্য জানুয়ারিতে যখন পাকিস্তানী সেনা প্রহরায় বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়, তখন তাঁর মনের গহীনে সৃষ্ট অনুভূতি তিনি পরে এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, তোমাকে আমি ভালবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২৫৬)। পূর্বে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় নুরু নামে সুকণ্ঠী এক কয়েদির গান শুনে বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, ‘গান গাও নুরু, বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে সেই গান গাও’ (ঐ, পৃ. ১৩০)। এর মধ্যেই প্রকাশ পায় বাংলা ও বাঙালীর প্রতি কী গভীর অনুরাগই না ছিল বঙ্গবন্ধুর! রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে ত্যাগই ছিল বঙ্গবন্ধুর পথ। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘ত্যাগের মাধ্যমে আদর্শের জয় হয়’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ৬৮)। ত্যাগের মহিমা সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুর কথা, ‘যেকোন মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোন ভাল কাজ করতে পারে নাই’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১২৮)। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ^াস করতেন, ‘দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে’ (ঐ, পৃ. ১৬৪)। তাই তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পেরেছিলেন, ‘জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেজন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ১৭৩)। বাঙালীর জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ত্যাগ করেছেন আর ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুর্নীতি ও অশিক্ষামুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’র লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ কর্মসূচী ঘোষণার পরপর তাঁকে পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যসহ ঘাতকদের হাতে নিজ জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করতে হয়। এস এ করিম তাঁর ঝযবরশয গঁলরন : ঞৎরঁসঢ় ধহফ ঞৎধমবফু (টচখ ২০০৫, ঢ়. ৩৮৩-৩৯১) গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুকে ‘ধ ঃৎধমরপ যবৎড়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাঙালীর ইতিহাসে সত্যিই তিনি ‘ট্র্যাজিক হিরো’। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁর অমর কীর্তি। রাষ্ট্রের স্বাধীন অস্তিত্ব আর মানুষের ভালবাসার মাঝে বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, চিরঅমøান। বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। তাঁর মহান আদর্শ বাঙালীর সোপান। জাতির পিতার কোন মৃত্যু নেই। মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু। লেখক : উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
×