ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কচিকাঁচা মুখে হাসি বাঁধভাঙ্গা আনন্দ আগামীর হাতছানি

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৪ জুলাই ২০১৭

কচিকাঁচা মুখে হাসি বাঁধভাঙ্গা আনন্দ আগামীর হাতছানি

মোরসালিন মিজান ॥ প্রতিযোগিতা এখন এত বেড়ে গেছে, এত যে, অবাক হতে হয়। ছোট ছোট বাচ্চারা বড়দের মতো পরিশ্রম করছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়ালেখা। কলেজ-কোচিং-প্রাইভেট-টিউটর কোনটাই বাদ দিচ্ছে না। আর এইচএসসি হলে তো কথাই নেই। শিক্ষা জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ভাল ফল তো উচ্চশিক্ষার সব দ্বার মোটামুটি খোলা। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি। ডাক্তার হব। ইঞ্জিনিয়ার হব। যদি হতেই হয়, উচ্চ মাধ্যমিকে ভীষণ ভাল ফল করতে হবে। এবং সত্যি সত্যি ভীষণ ভাল ফল করেছে ছেলেমেয়েরা! রবিবার প্রকাশিত ফলাফলে যার পর নাই আনন্দিত তারা। শহর ঢাকার বিখ্যাত কলেজগুলোতে এদিন ছিল উৎসবের আমেজ। ভালভাবে উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পাস মাতিয়ে রেখেছিল। তাদের নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় দেখে মন ভরে গেছে বাবা-মায়ের। অনেকে তো কাঁদছিলেন। সন্তানের সাফল্যে যে কান্না সে তো হাসির অধিক। সব বোর্ডের ফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এবার উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করেছে ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আট শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে পাসের হার বিবেচনায় প্রথম হয়েছে সিলেট। দ্বিতীয় রাজশাহী। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বরিশাল বোর্ড। জিপিএ-৫-এর মোট সংখ্যাটি ৩৭ হাজার ৯৬৯। সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। ১৮ হাজার ৯৩০ জন এই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে। পাসের হারসহ অন্যান্য পরিসংখ্যানেও যথারীতি এগিয়ে আছে রাজধানীর বিখ্যাত কলেজগুলো। সঙ্গত কারণেই এসব কলেজের ক্যাম্পাস হাসিরাশি আনন্দ উদ্যাপনের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। আগেই জানা ছিল দুপুর ১টা নাগাদ পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে। তাই আগে থেকে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে সমবেত হতে শুরু করে শিক্ষার্থীরা। সময় যত গড়ায় উত্তেজনা তত বাড়ে। টেনশন নিতে না পেরে অনেকেই একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল উল্টো চিত্র। সে ছেলেমেয়েরাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। চিৎকার-চেঁচামেচিতে মাথায় তুলল ক্যাম্পাস! দুপুরে ভিকারুননিসা নূন কলেজের ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, ফল প্রত্যাশীদের উপচেপড়া ভিড়। ইউনিফর্ম পরে আসা মেয়েরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বসেছিল। ফল হাতে পাওয়া মাত্রই শুরু হয়ে যায় দিগি¦দিক ছোটাছুটি। ফড়িংয়ের মতো উড়ছিল তারা। ততক্ষণে বেজে ওঠে স্কাউট সদস্যদের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র। সঙ্গে নাচ। যে যেমন খুশি নেচে গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছিল। এ অবস্থায় কারও সঙ্গে কথা বলা মুশকিল। অনেক চেষ্টা করে দুইজনকে পাওয়া গেল। তানিয়া নামের এক শিক্ষার্থী বলল, অনেক কষ্ট করেছি। অনেক। এর পরও গত রাতে ঘুমাতে পারিনি। একটু পর পর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এখন জানলাম, জিপিএ-৫ পেয়েছি। কী যে ভাল লাগছে, বলে বোঝাতে পারব না। চিকিৎসক হতে চায় বলে জানায় তানিয়া। পাশেই ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নিগার। নাচতে নাচতে ক্লান্ত সে। বলল, কেন নাচব না? পরীক্ষার আগে তো বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলারও সুযোগ পাইনি। শুধু পড়ো আর পড়ো। এখন আমরা যা খুশি তা-ই করব! এমন কথা শুনে না হেসে পারা যায় না। মনে মনে ‘ঠিক আছে কর’ বলতে না বলতেই সে দৌড়ে যায়। যোগ দেয় অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। যেতে যেতে বলে যায়, দোয়া করবেন। আমিও ডাক্তার হব! ঢাকা কলেজ শুধু ছেলেদের। এখানে আনন্দ কম। দুষ্টুমিটাই বেশি দেখা গেল। এর পরও কেউ কেউ মন খারাপ করে ছিলেন। তাদের একজন শিহাব। বললেন, জিপিএ-৫ না পাওয়ার কোন কারণই ছিল না। অথচ সেটা হয়নি। এখন কী হবে? খুব টেনশন করছিল সে। পাশে দাঁড়িয়ে এক বন্ধু তাকে সান্ত¡না দিচ্ছিল। বলছিল, এ্যাডমিশন টেস্টে ভাল কর। দেখবি ইউনিভার্সিটিতে ঠিক হয়ে যাবে। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের ক্যাম্পাস শুধু নয়, গোটা এলাকাজুড়েই ছিল উৎসবের আমেজ। প্রতিষ্ঠানের গেটে গিজ গিজ করছিল শিক্ষার্থী। ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই মনে হলো, আনন্দযজ্ঞ। এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে জড়িয়ে ধরছিল। নানাভাবে প্রকাশ করছিল পরীক্ষা পাসের উচ্ছ্বাস। জিপিএ-৫ পাওয়া তন্ময়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মজার কথা শুনাল সে। বলল, ফল খারাপ হলেও সমস্যা ছিল না। আমার দিক থেকে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমার বাবা-মাকে তো চেনেন না, এরকম কিছু হলে হার্টফেল করত। তাদের মুখে এখন হাসি। মা পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। নিজ থেকেই বললেন, আমাদের সময় এত প্রতিযোগিতা ছিল না। এখন যে অবস্থা, ঠিকমতো লেখাপড়া না করলে হবে? আমার ছেলে সেটা বুঝতে চায় না। সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেত। তাই শঙ্কায় ছিলাম। এখন ফল দেখে তিনি ভীষণ খুশি বলে জানান। ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, একদিন বাবা-মা হবে। তখন সন্তানের জন্য ভেতরটা কেমন করে। হ্যাঁ, বাবা-মায়েদেরও এদিন আনন্দে ভাসতে দেখা গেছে। অনেক বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে কলেজে এসেছিলেন। ভাল ফল নিশ্চিত হওয়ার পর তারা প্রিয় সন্তানকে জড়িয়ে ধরেছেন। চুমু খেয়েছেন। সন্তানের সাফল্যে গর্বিত পিতামাতার চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। মতিঝিল আইডিয়াল থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া মাহরুফার মা বলছিলেন, মেয়ের পরীক্ষা ছিল না। নিজেই যেন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলাম। তাই চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না। এদিকে, দুপুরের পর হাসিমুখে বাসায় ফেরে শিক্ষার্থীরা। আর তখন শুরু হয় উৎসব-আনন্দের দ্বিতীয় পর্ব। সফল শিক্ষার্থীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। প্রিয়জন পরিচিতজনদের বাসায়ও পাঠানো হয় মিষ্টি। সেই সঙ্গে ছিল ফুল। কোন কোন বাসায় ছোট বোন বড় ভাইকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। কোথাও কোথাও বড় ভাই মজার গিফট কিনে এনেছে ছোট বোনের জন্য। সব মিলিয়ে অন্যরকম সুন্দর একটি দিন। এই সুন্দর আরও বেশি সুন্দরের দিকে যাত্রা করুক। আরও বড় বড় সাফল্য ধরা দিক শিক্ষার্থীদের জীবনে। শুধু পরীক্ষায় ভাল করা নয়, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। তবেই স্বার্থকতা। বাংলাদেশের সুন্দর আগামী, অভিনন্দন তোমাদের।
×