ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ পাচার রোধে সরকারের কি সদিচ্ছার অভাব?

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২২ জুলাই ২০১৭

অর্থ পাচার রোধে সরকারের কি সদিচ্ছার অভাব?

অর্থনৈতিক রিপোর্টার॥ সুইটজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় বিশ শতাংশ বেড়েছে।এই অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস বা সেকেন্ড হোম নির্মাণ কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণের তালিকায় বাংলাদেশিরা তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। সুইস ব্যাংকগুলোতে এবছর বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় বিশ শতাংশ বৃদ্ধির খবর এসেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, সুইস ব্যাংকের হিসাব প্রকাশ হওয়ার পর অর্থ পাচারের ইস্যু আবার সামনে এসেছে।কিন্তু গত কয়েকবছরে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে গেছে, তার একটা ছোট অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, "গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটিসহ অন্যান্য সংস্থা থেকে রিপোর্ট যা পাচ্ছি, তাতে দেখছি, আট নয় বিলিয়ন ডলার গত কয়েকবছর ধরে যাচ্ছে।এছাড়া মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ যাচ্ছে।" সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব প্রকাশের কিছুদিন আগে ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি বা জিএফআই বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থ বৃদ্ধির খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।কিন্তু অর্থ পাচারের অভিযোগকে আমলে নিতেই রাজি নন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। কয়েকদিন আগে সংসদে তিনি বলেছেন, অর্থ পাচারের বিষয়টি নজরে নেয়ার মতো নয় বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, "টাকা পাচারের বিষয়টি বাস্তবে তেমন কিছু নয়।সুইস ব্যাংকের যে হিসাব কাগজে বেরিয়েছে, এগুলো হলো লেনদেনের হিসাব।হাঁ, সত্যিই কিছু পাচার হয়।সেটা যৎসামান্য।" বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের আইন অনুযায়ী অর্থপাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার কর্মকান্ড সমন্বয় করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সুইস ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাব পর্যালোচনা করেছে।সেই পর্যালোচনার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহাও বলছেন, অর্থ পাচারের পরিমাণ খুব বেশি নয়। অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বড় অংকের অর্থ পাচারের বিষয় মানতে না চাইলেও এনিয়ে তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। অর্থ পাচার কিভাবে হচ্ছে, তা নিয়েও আলোচনার শেষ নেই।যদিও হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারের একটা অভিযোগ দীর্ঘ সময় ধরেই বাংলাদেশে রয়েছে।কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে দাম কম বেশি দেখিয়েই মূলত অর্থ পাচার করা হয়। মোস্তাফিজুর রহমান বলছিলেন, আমদানির রপ্তানির সময় দাম গোপন করে অর্থ পাচারের বিষয়টিই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, "শতকরা ৮০ভাগই যাচ্ছে, আমদানি-রপ্তানির সময়। আমদানি মূল্যটাকে বেশি করে দেখানো হচ্ছে।আবার রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল্য কম করে দেখানো হচ্ছে।এর মাধ্যমেই বড় অংকের টাকা চলে যাচ্ছে।" আমদানি রপ্তানির সময় পণ্যের দাম গোপন করার অভিযোগ যখন আসছে, তা নিয়ে আবার ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।অভিযোগটি অযৌক্তিক বলেই উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, "আমি এর সাথে এগ্রি করিনা।সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া কোনো কম্যুনিটিকে অর্থ্যৎ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক বা আমলা, কাউকেই অভিযুক্ত করা ঠিক নয়। ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং সম্পর্কে কারও কনসেপ্ট পরিস্কার নয়।যেমন আমেরিকাতে আমাদের যদি অ্যাপারেল যায়, এই যাওয়ার ক্ষেত্রে শতকরা ১৫থেকে ৩৪ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হয়।এখন বৈধভাবেই যদি কেউ এই ট্যাক্স কমাতে পারে। সেটা কি খারপ কিছু হলো?" তবে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিরা যে অর্থ রেখেছেন, তাদের নাম পরিচয় জানার কি কোন উপায় আছে? এই প্রশ্ন এখন উঠেছে।কারণ সুইস ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে, সেই তথ্য তারা আগে প্রকাশ করতো না।এখন দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী কয়েক বছর ধরে তারা শুধু জমাকৃত অর্থের পরিমাণটা প্রকাশ করছে। এখনকার আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তথ্য দেয়ার ব্যাপারে ঐ ব্যাংকগুলোর উপর চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন দুর্নীতি বিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, "এখন আন্তর্জাতিক আইনী কাঠামোর কারনে যে দেশে অর্থ যাচ্ছে, তারা অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করছে।এছাড়া জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের কারনে দেশগুলোর মধ্যে তথ্য আদান প্রদানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।" জাতিসংঘের দুর্নীতি বিরোধী যে সনদ আছে, এর বাইরে বাংলাদেশ অর্থ সরবরাহের তথ্য জানার জন্য ৫১টি দেশের সাথে দ্বিপক্ষিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে।এরমধ্যে মালয়েশিয়ার সাথে এই সমঝোতা থাকায় দেশটিতে সেকেন্ড হোম নির্মাণকারি বাংলাদেশিদের অনেকের তথ্য আনা হয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের শুভংকর সাহা বলছিলেন, সুইটজারল্যান্ডের সাথে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক না থাকায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তারা তথ্য দেয় না। তিনি বলেন, "সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া সুইস ব্যাংক ঢালাওভাবে তথ্য দেয় না।তবে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বঅংলাদেশিদের অর্থ নেয়ার কিছু অভিযোগ পেয়েছিলাম।সেগুলোর ব্যাপারে আমরা মালয়েশিয়া থেকে তথ্য এনেছি।সেই তথ্যে পাওয়া গেছে যে,কেউ কেউ এখান থেকে নিয়ম ভেঙ্গে অর্থ পাচার করেছে।তাদের ব্যাপারে এখন দুদক তদন্ত করছে।" মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস বা সেকেন্ড হোম নির্মাণকারি বাংলাদেশিদের কয়েকজনের ব্যাপারে এখন অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক।তবে দুদকের সচিব আবু মো: মোস্তফা কামালের বক্তব্য হচ্ছে, অর্থপাচার প্রতিরোধ সম্পর্কিত এখনকার আইনে তাদের কর্মপরিধি সীমিত করা হয়েছে এবং সেই সীমানার মধ্যেই তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, "মানি লন্ডারিং আইনে সম্প্রতি যে সংশোধনী আনা হয়েছে। তাতে ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের কথা এসেছে।এর মাত্র একটি অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব দুদকের উপর দেয়া হয়েছে। ঘুষ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ পাচার করা হলে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।সেই দায়িত্বই আমরা পালন করছি।" অর্থ পাচার প্রতিরোধ সম্পর্কিত আইনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড,এবং সিআইডি পুলিশকে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়েছে।কিন্তু ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।একইসাথে তিনি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, "যারা অর্থ পাচার করে, তাদের অর্থের একটা আছে। সেটা রাজনৈতিক প্রভাবে রুপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা, ঝুঁকি এবং বাস্তবতা বাংলাদেশে বিরাজ করছে।সেই প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থা নিতে বেশি প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।" সরকার এমন অভিযোগ মানতে রাজি নয়।অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান অর্থ পাচার রোধে তাদের শক্ত অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "অর্থ পাচার রোধে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই।কারন মানিলন্ডারিং এর বিরুদ্ধে এই সরকারই আইন করেছে।এ সরকারই দুদককে শক্তিশালী করেছে।" তবে কঠোর আইন করে বা আইনী ব্যবস্থা নিয়েই কী অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব, এই প্রশ্ন তুলছেন ব্যবসায়ীরা।ব্যবসায়ী নেতা সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করেন,শুধু আইনের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ করা যাবে না।দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "দেশে বিনিয়োগের নিশ্চিত পরিবেশ থাকলে কেউ টাকা বিদেশে নেবে না। বরং বিদেশী বিনিয়োগকারিরাই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে। সেই পরিবেশ এখন তৈরি হয়েছে।" বিশেষজ্ঞরা কিন্তু দেখছেন ভিন্নভাবে।তারা বলছেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করার পরও অবৈধ অর্থ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার চেষ্টা থাকতে পারে।ফলে বিনিয়োগের পরিবেশ যেমন নিশ্চিত করতে হবে।একইসাথে কঠোর আইনী ব্যবস্থা এবং তার প্রয়োগ দৃশ্যমান হলে অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হতে পারে। সূত্র: বিবিসি
×