ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অন্য এক গাজী শাহাবুদ্দিন -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৬ জুন ২০১৭

অন্য এক গাজী শাহাবুদ্দিন -স্বদেশ রায়

ঢাকা ক্লাব থেকে হাল্কা লাঞ্চ ও কিছু সফট ড্রিঙ্কস নিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে টঙ্গীর দিকে যাত্রী গাজী ভাই ও আমি। গাজী ভাইয়ের ধারণা মাছ সম্পর্কে আমার খুব ভাল ধারণা আছে। তাই শুধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এলে বা কাইয়ূম চৌধুরীর বাসায় কোন পার্টি থাকলে মাছ কেনার সময় আমাকে ডাকা নয়, এবার তিনি আমাকে নিয়ে চলেছেন, কালীগঞ্জে তার পৈত্রিক বাড়িতে মাছ চাষ সঠিক হচ্ছে কিনা তার একটি বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার জন্য। এতদিনে গাজী ভাইকে আমি পড়তে শিখেছি, তাই তার মাছ চাষের সঙ্গে কতখানি বৈষয়িক দিক থাকবে তা ভাল মতোই বুঝেছি। তার পরেও আউটিং, মাছ চাষ, পূবাইল বিল, হিজল গাছ সব মিলে কম কি? আজ হয়ত আর সেই পূবাইল বিল নেই। তখন পূবাইল বিল ছিল মুক্তার জন্য বিখ্যাত। সেখানে যারা মুক্তা খুঁজত সেই মুক্তা সঠিক কিনা এবং তার ক্রেতা তখন বীথি শাহাবুদ্দিন। বীথি শাহাবুদ্দিনও এগুলো কিনতেন গাজী ভাইয়ের বন্ধুদের স্ত্রীদের গিফট করার জন্য। তখন পূবাইল ব্রিজ পার হওয়ার পরে কালীগঞ্জের দিকে যেতে একটি ফেরি ছিল ছোট একটা নদীতে। নদীর কূল জুড়ে থাকত বেদেদের নৌকা। গাড়ি ফেরি পার না করে ড্রাইভার মকবুলকে এক পাশে পার্কিং করে গাজী ভাই প্রায়ই বসতেন নদীর ধারের একটি বটগাছের শিকড়ের ওপর, কৌতূহল নিয়ে দেখতেন বেদেদের জীবনযাত্রা। কয়েক বার যাতায়াতের ফলে বেদেরাও কীভাবে চিনে ফেলে গাজী ভাইকে। তাদের অনেকে এসে তার কাছে সাহায্য চাইতেন। গাজী ভাই পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা পেতেন তাই দিয়ে দিতেন। কেনাকাটার সময় ছাড়া গাজী শাহাবুদ্দিনকে কখনও গুনে টাকা দিতে দেখিনি। সেদিনও তার থেকে অন্য কোন ঘটনা ঘটেনি। বেদেদের কিছু সাহায্য শেষ হতেই আমাদের গাড়ি এঁকেবেঁকে চলতে শুরু করল কালীগঞ্জের সরু রাস্তা ধরে। গাজী গোলাম মোস্তফার আমলে তৈরি রাস্তা। এতদিনে হয়ত ওই রাস্তা অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ, এ সম্ভবত পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের কথা। ওই রাস্তাটা মনে মনে খুব পছন্দ করতাম দুই কারণেÑ একদিকে বিলের ভেতর হিজলগাছ, অন্যদিকে গ্রামের সাধারণ মাটির ঘর। গাজী ভাইদের বাড়িতেও একটা মাটির ঘর ছিল। সেখানে যিনি থাকতেন, ওই ভদ্রমহিলা ঢাকার নবাব পরিবারের মেয়ে। এখনও তারা বছরে কয়েক টাকা নজরানা পান নবাবের বংশধর হিসেবে। আমাদের কাউকে নিয়ে গেলে গাজী ভাই তাকে এক পাশে ডেকে তার হাতে কিছু টাকা দিতেন। তারপরে যা হতো সে একটা নবাবী ভোজ। ভদ্রমহিলা ও তার ছেলেমেয়েরা হাতপাখা নিয়ে বসতেন। তাদের হাতপাখার মৃদু বাতাসের নিচে বসে গাজী ভাই খুবই সামান্য খেতেন। কিন্তু রান্না থেকে পরিবেশন অবধি কোথাও বলে দিতে হতো না সবই শরীফ কালচার। দু’জনের কথাবার্তাই বলে দিত একজন গাজীপুরের জমিদার পরিবারের আর একজন ঢাকার নবাব পরিবারের। কেউ কখনই উঁচু গলায় কোন কথা বলতেন না। ঢাকা ক্লাবের লাঞ্চ আর ড্রিঙ্কস শেষ করে আমরা যখন কালীগঞ্জে গাজী ভাইদের বাড়িতে পৌঁছাই তখন বিকেল হয়ে এসেছে। গাজী ভাই যাবেন এটা আগের থেকে নির্ধারিত ছিল। গিয়েই বুঝতে পারি। কারণ গাজী ভাইয়ের কেয়ারটেকার জাল ও জেলে উপস্থিত রেখেছেন। সপ্তাহ বা দুসপ্তাহ অন্তর গাজী ভাই তার বন্ধুদের নিয়ে যান। এই সময়ের ভেতর মাছ কত বড় হলো সেটা জেলেদের দিয়ে জাল টাঙিয়ে গাজী শাহাবুদ্দিনকে দেখাতে হয়। মাছগুলোকে পানির ওপরে উঠতে দিতেন না তিনি কখনও। কোথায় যেন একটা কষ্ট পেতেন। মাছ দেখা শেষ হলে তার থেকে বড় কয়েকটি মাছ তিনি তুলে ফ্রাই করতে বলতেন। খুব বড় পুকুর নয়, ছোট্ট একটা পুকুর। তার পাড়ে গাজী ভাই লন চেয়ার ও আমব্রেলা থাইল্যান্ড থেকে আনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অথচ সারাক্ষণ তিনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন, এ বছর তিনি এই পুকুরের মাছ থেকে বেশকিছু টাকা পাবেন। আর তার জন্যই তার এই আসা যাওয়া। আসলে এ যে এক উদাসী শিল্পীর খেলা তা বুঝলেও কখনও বলে তাকে লজ্জিত করিনি। ওই পুকুর পাড়ে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেক লেখককে নিয়ে গেছেন। অনেকবারই সঙ্গী হয়েছি। ওখানে বসে ড্রিঙ্কস আর মাছ ফ্রাই খাওয়া শেষ হতেই গাজী ভাইয়ের কেয়ার টেকারসহ অনেকেই হাজির হতেন। সবাই তার কাছে হাত পাতত। তাদের যেন এটা পাওনা। গাজী শাহাবুদ্দিন যখন এসেছেন তখন প্রত্যেককে কিছু দিয়ে যাবেন। তবে তাকে বেশি ফাঁকি দিত, তার কেয়ার টেকার ও তার স্ত্রী। ওই পুকুরের মাছের খাবার ও তার কিছু জমিতে ধান চাষ করার জন্য যে টাকা তারা নিতো তার এক শ’ ভাগের এক ভাগও কখনও উঠে আসা সম্ভব ছিল না গাজী ভাইয়ের ওই বিনিয়োগ থেকে। অনেক সময় এ নিয়ে বিরক্তও হতাম। কেন তিনি এ অপচয় করেন এদের পেছনে। গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই একদিন মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারেন। আমাকে বলেন, তুমি ওকে (তার কেয়ার টেকার) নিয়ে বিলে নৌকায় ঘুুরে এসো। আর ও আগে কী করত তা শুনো? কেয়ার টেকারটির নাম মনে নেই, চেহারা এখনও চোখের সামনে ভাসে। কালো গায়ের রং, ভাস্করের হাতে ছানা মাটিতে দুর্গার বর্শা বুকে নেয়া মহিষাশুরের মতো শরীর। পূবাইল বিলের জলের ওপর দিয়ে উদাসী হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে তাকে প্রশ্ন করি, গাজী ভাইয়ের এই কেয়ার টেকার হওয়ার আগে সে কী কাজ করত। অত্যন্ত সাবলীলভাবে বলল, ‘ডাকাতি করতাম’। কোথায় ডাকাতি করতে? সে উত্তর দিল, কেন এই বিলে? বিলে কীভাবে ডাকাতি করতে? রাতে এই বিল দিয়ে যে সব নৌকা চলত ওই নৌকায় ডাকাতি করতাম। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা শুনেছি পূবাইল বিলের ডাকাত বা অন্যান্য বড় বিলের ডাকাতরা নাকি ডাকাতি করে আবার মানুষও খুন করে। তাই অনেকটা খেয়ালের বশেই জিজ্ঞেস করলাম, মানুষ টানুষ খুন করেছ নাকি? সে খুব স্বাভাবিকভাবে, মুখের ওপর কোন ছায়া না ফেলে বলল, হ্যাঁ করেছি? বললাম, ক’জনকে খুন করেছ। বলল, করেছি বেশ কয়েকজনকে মনে নেই- কজন হবে? কীভাবে খুন করেছো? তার সাদামাটা উত্তর কেন, দা দিয়ে এক কোপ দিয়ে গলা কেটে ফেলতাম। আমাদের নৌকা তখন বিলের অনেক ফাঁকা স্থানে পৌঁছে গেছে। নিজের ঘাড় কেমন শির শির করতে লাগল। হাসতে হাসতে তাকে বলি, তোমার কাছে এখন দাটা নেই তো। হেসে দেয় সে। কালো মুখে ঝক ঝকে সাদা দাঁতের হাসি বড় অসুন্দর মনে হয়। কোথাও তার চোখেমুখে কোন পাপীর চিহ্ন নেই। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কাছের থেকে দেখেছি অনেকবার, তাদের দেখলে খুনী মনে হতো। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে হাত মেলায়নি। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যতবার জীবনে দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে লোকটি খুনী। কিন্তু পূবাইল বিলের ওই মানুষটি নিজে মুখে বলার পরেও তাকে খুনী মনে হয়নি, কোথায় যেন একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। যা হোক, তাকে নৌকা ফেরাতে বলি, গাজী ভাই ও তার অন্য বন্ধুদের তখন যাওয়ার সময় হয়েছে। গাজী ভাইয়ের ভেতর আরেকটি বিষয় সব সময়ই লক্ষ্য করেছি, নিজের ব্যস্ততা, নিজের প্রয়োজন কোন কিছুর জন্যই তিনি অন্যের দেরি হওয়া বা অন্য কিছু ভাবাকে কখনই বিরক্তির সঙ্গে নিতেন না। বরং তিনি বোঝাতে চেষ্টা করতেন, তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আর অন্যতম যে নাগরিক চরিত্রের প্রকাশ তার ভেতর দেখেছি তা অভাবনীয়, তিনি হয়ত কোন একটা কথা বলছেন, কথা শেষ হয়নি তখনও এর ভিতর অন্য কেউ কিছু বলতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে থেমে যেতেন গাজী ভাই। যাহোক, নৌকা নিয়ে ঘাটে ফিরতেই দেখি শুধু কেয়ার টেকারের স্ত্রী আছে অন্যরা দূরে দাঁড়িয়ে। বুঝলাম, অন্যদের টাকা নেয়া শেষ। কেয়ার টেকার ও তার স্ত্রী আমাদের গাড়িতে মাছ ও কয়েকটি সবজি তুলে দেয়ার পরে গাজী ভাই আজও প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে যা হাতে এলো তুলে দিলেন ওদের হাতে। সেদিন গাজী ভাই আর আমার চোখে চোখ পড়েছিল। দু’জনই দু’জনের চোখের ভাষা বুঝি। তখন মনে হয়, গাজী ভাই তো বিবেকানন্দ পড়েননি ওইভাবে তাহলে উনি কীভাবে বিবেকানন্দের এ উপদেশ নিজের জীবনে নিলেন। ‘তুমি যদি গোটা সমাজকে পরিবর্তন করতে না পার অন্তত পাশের দু’-একজনকে কর।’ এটুকু ভেবেই নিজের ভুল নিজেই বুঝতে পারি, আসলে যিনি গাজী শাহাবুদ্দিন হন, তার বিবেকানন্দ পড়া লাগে না। তার স্বভাবের ভেতরই বিবেকানন্দ থাকেন। বাঙালী সংস্কৃতির জন্য, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য, বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের জন্য, বাংলাদেশের এক ঝাঁক লেখক ও সাংবাদিকের জন্য গাজী শাহাবুদ্দিন কী করেছেন সে ইতিহাস ভবিষ্যত প্রজন্ম নিজের প্রয়োজনেই ইতিহাসের পাতা খুঁড়ে বের করে আনবেন। কিন্তু কালীগঞ্জের পূবাইল বিলের একজন মানুষ হত্যাকারী ডাকাতকে সাজা না দিয়ে তাকে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত করতে গাজী শাহাবুদ্দিন কী করেছিলেন তার ইতিহাস কোথাও থাকবে কি? সচিত্র সন্ধানীর একটি পর্যায়ে এসে ওই পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে আমার কাঁধে। এ সময়ে একদিন খুব মিষ্টি মুখের একটি ছেলে এসে বলল, তার এ পৃথিবীতে কেউ নেই। সে ক্লাস টেন অবধি পড়াশোনা করেছে। সন্ধানীর পাঠক সে, তাকে একটা কাজ দিতে হবে। তাছাড়া দুই দিন হলো না খেয়ে আছে। শ্যামল রঙের ছেলেটি দেখে মায়া হলো, নিয়ে গেলাম গাজী ভাইয়ের কাছে। সে নিজেই তার সমস্যার কথা বলে গাজী ভাইকে। গাজী ভাই বলল আচ্ছা থাকুক কথাকলিতে। কাজ শিখুক আর ওদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করুক। কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল সে বড়ই করিতকর্মা ছেলে। ভয় ডরও তার কিছু নেই। বুঝতে পারলাম রবীন্দ্রনাথের সেই আপদ আর কি? মনে মনে হেসে ভাবি আমরা সবাই তো গাজী শাহাবুদ্দিনের রবীন্দ্রনাথের সেই আপদ। তার ভেতর অন্য রকম আরেকজন আর ক্ষতি কি? ওই আশির দশকে গাজী শাহাবুদ্দিনের মাসিক সিগারেট বিল উঠত সতেরো থেকে বিশ হাজার টাকা। প্রথম দিন তো এ বিল পেয়ে আমি মনে করেছিলাম গাজী ভাইয়ের মনে হয় সিগারেটের ব্যবসা আছে। কারণ তখনও আমি গাজী শাহাবুদ্দিনের আয়তন বুঝতে পারনি। পরে দেখেছি তার কত যে বন্ধু রথম্যানের প্যাকেটটা নিয়্ েএকটা মুখে দিয়ে প্যাকেটটি পকেটে রেখে দিতেন। গাজী ভাই ড্রয়ার থেকে আরেকটি প্যাকেট তুলে টেবিলের ওপর রাখতেন। সেখানে এরকম একজন আপদ থাকবে তাতে আর দোষের কি? এর ভিতর আবার সন্ধানী বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু প্রকাশনী আছে। আমিও ভিন্ন পত্রিকা অফিসে। তার পরেও আমার ঢাকা শহরের ঠিকানা গাজী ভাইয়ের অফিস। বিকেল হলে রাজনীতিক, সাংবাদিকসহ সব বন্ধু ওখানেই আমাকে খোঁজে। কোন কোন দিন দুপুরজুড়ে বসে আমাদের আড্ডা ওই অফিসে। তাই প্রতিদিন সেখানে আসা যাওয়া। হঠাৎ একদিন সকালে এসে শুনি প্রেস থেকে কয়েক ঠেলাগাড়ি কাগজ ওই ছেলেটি রাতের বেল পিছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে চলে গেছে। রাস্তা থেকে আসা ছেলে তার কোন ঠিকানাও নেই। কোথায় খুঁজবে তাকে। গাজী ভাইয়ের যা স্বভাব, বিষয়টি জেনে নীরবে চলে গেলেন। যেন কোন কিছু ঘটেনি। প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন তখন একজন আর্টিস্ট। কাইয়ূম চৌধুরী স্যারের ছাত্র রব্বানী। সুদর্শন রব্বানীর লাল টকটকে মুখ লজ্জায় ও রাগে আরও লাল হয়ে গেছে। সে ততক্ষণে মতিঝিল থানায় একটি জিডি করে এসেছে। অবশ্য গাজী ভাইয়ের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। আর মাথাব্যথা হলে তো আর গাজী শাহাবুদ্দিন হন না কেউ। গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের আরেক সঙ্গী ছিলেন কেশব দা। তার পদবি এ মুহূর্তে ভুলে গেছি। চিরকুমার মানুষটি গাজীভাইকে বুঝতেন, বুঝতেন বীথি ভাবিকে। গাজী ভাইয়ের দুই ছেলেমেয়ে বাবু ও শুভ্র কেশবদার কোলে-পিঠেই থাকত। যাহোক, কেশবদার কাছে গল্প শুনেছি, গাজী ভাইয়ের বাবার পাগলায় একটা বড় বাগান বাড়ি ছিল। গাজী ভাই একবার পত্রিকাসহ কী কী কাজে যেন টাকার কমিটমেন্ট করেছেন। কিন্তু সময় মতো টাকা যোগাড় হচ্ছে না দেখে তিনি ওই বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। বাড়িটায় গাজীভাই ওইভাবে কোনদিন যাননি, তাই মোটের ওপর বাড়ি না দেখে তিনি একজন কাস্টমারকে কথা দেন সাত লাখ টাকায় তিনি বাড়ি তার কাছে বিক্রি করবেন। এই কথা জানতে পেরে পাগলার ওখান থেকে অন্তত দশ বারোজন কাস্টমার আসে। তাদের শুধু একটি কথা, স্যার আপনি একবার চলেন, বাড়িটা দেখেন তারপরে ওই দামে বিক্রি করেন। ্আপনাদের যে বাংলো আছে তার দামই সাত লাখ টাকা। গাজী ভাইয়ের এক কথা- না তিনি কথা দিয়েছেন। তাই রব্বানীর রাগ দেখেও আমরা বুঝতে পারি, গাজী ভাই সকালে ওটা শুনেছেন ওখানেই শেষ। এই নিয়ে তার আর কোন মাথাব্যথা নেই। এর পরে কয়েক বছর কেটে গেছে। রব্বানী তখন আর গাজী ভাইয়ের ওখানে চাকরি করে না। আমি তখন সম্ভবত যায়যায়দিনের দায়িত্বে। কিন্তু দিনান্তে একবার গাজী ভাইয়ের ওখানে যাওয়া হয়। সেদিন সম্ভবত পত্রিকা বের হয়েছে তাই ওই দিন কোন কাজ ছিল না। খুব সকালে শফিকুল আজিজ মুকুল ভাইয়ের পল্টনের বাসায় গিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দেই, সেখান থেকে বের হয়ে মফিদুল হক ভাইয়ের ওখানে কী যেন একটা কাজ ছিল- সে কাজ সেরে যাই গাজী ভাইয়ের ওখানে। গাজী ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই গাজী ভাই বললেন, যাও পেছন দিকে দেখে এসো কে বসে আছে। পেছনে গিয়ে দেখি রব্বানী। সে তো আমাকে দেখে খুব উত্তেজিত। কারণ যে ছেলেটি কাগজ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, আমি যাকে চাকরি দিয়েছিলাম সে সেদিন কোন কাজে চারুকলায় ঢুকেছিল। আর পড়বে পড় রব্বানীর সামনে। রব্বানী তাকে পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে। তার ইচ্ছে, মতিঝিল থানায় যেহেতু জিডি করা আছে অতএব তাকে থানায় হস্তান্তর করবে। কিন্তু বাদ সাধছেন গাজী ভাই। কারণ ইতোমধ্যে গাজী ভাই জেনেছেন, ওই ছেলে বিয়ে করেছে। গাজী ভাইয়ের বক্তব্য ওকে জেলে দিলে একটা নিরপরাধ মেয়ে শুধু শুধু কষ্ট পাবে। বরং তার বউকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর। কিছুক্ষণের মধ্যে তার স্ত্রী এলো। গাজী ভাই তার কাছে এটুকুও বললেন না যে সে এখান থেকে কাগজ চুরি করেছিল। শুধু বললেন, ও একটি অন্যায় করেছে ওকে বলো আর যেন কোনদিন এসব কাজ না করে। ভালভাবে চলতে বলো। তারপরে তার দীর্ঘদিনের পিয়ন সালামতকে ডেকে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন ওদের একটু সামনের কোন হোটেল থেকে খাবার ব্যবস্থা করে দিতে। এরশাদ পতনের আগে ৮৯ সালের দিকে বিএনপির সমর্থক এক যুবকের আত্মদান নিয়ে একটি রিপোর্ট করি যা সচিত্র সন্ধানী ও বিবিসিতে প্রচার হয়। পরবর্তীতে এই কাহিনী নিয়ে জাকির হোসেন রাজু মিছিলের মুখ শর্ট ফিল্মটি তৈরি করে। এই রিপোর্টটি করতে গিয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে এক ধরনের আত্মার বন্ধন গড়ে ওঠে। মনোয়ার নামে যে ছেলেটি মারা যায় তার বাবা যক্ষ্মার রোগী। ছোট একটা ভাই, তিন বোন বিবাহযোগ্য। মায়ের চোখে অসুখ। তাদের এই করুণ জীবনযাত্রার কথা আতাউস সামাদ ভাইকে বলি এবং এও বলি ছেলেটিকে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন যুবলীগের বলে দাবি করছে কিন্তু ওর মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে প্রথম যখন ওদের বাড়িতে যাই আশপাশের ছেলেদের কাছ থেকে জানতে পারি ও বিএনপি সমর্থক। তা ছাড়া ছেলেটির ঘরে আমি জিয়াউর রহমানের ছবি দেখেছি। এ কারণে আমিই শুধু আমার রিপোর্টে তাকে বিএনপির কর্মী বলে উল্লেখ করেছি। পাশাপাশি সামাদ ভাইকে বলি, বেগম জিয়াকে বলতে তিনি যেন কিছু সাহায্য করেন। সামাদ ভাইয়ের কাছে এ খবর পেয়ে বেগম জিয়া তাদের বাড়িতে কুলখানিতে যাওয়ার মত দেন। কুলখানিতে গিয়ে ওই দরিদ্র পরিবারটিকে বেগম জিয়া পাঁচ শ’ টাকার দুখানা নোট দিয়ে আসেন। বেগম জিয়ার আচরণ দেখে অসহায় এ পরিবারটির কথা গাজী ভাইকে বলি, গাজী ভাই লোক পাঠিয়ে ওদের ছোট ছেলেটিকে ডেকে এনে তার ওখানে কাজ দেন ও তাদের হাতে বেশকিছু টাকা দেন। এর কিছুদিন পরে ওই ছেলেটি আর আসে না দেখে গাজী ভাই আমাকে তার খবর নিতে বলেন। কয়েকদিন পরে গিয়ে জানতে পারি, তারা এখন মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন এর সঙ্গে আছে। গোটা পরিবার আওয়ামী লীগের ভক্ত হয়ে গেছে। কারণ বিএনপির কেউ আর তাদের খোঁজ নেয়নি। কিন্তু মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন নিয়মিত সাহায্য করেন। ছেলেটিকে লালবাগে কি যেন একটা কাজও দিয়েছেন। গাজী ভাই আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, তুমি বাসায় যাওয়ার পথে ওদের দিয়ে যেও। এমনি অসংখ্য ঘটনাজুড়ে আছে গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, যিনি আমাদের গাজী ভাই তাকে ঘিরে। কোন ঘটা নেই, কোন আড়ম্বর নেই তার স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে ঘটে এসব ঘটনা অতি নীরবে যেমন নীরবেই তিনি চলে গেলেন। বাংলাদেশে এখন মিডিয়ার বুম হয়েছে, যার হাতে সুস্থ মিডিয়ার ধারা সৃষ্টি হয়েছিল তাকে নিয়ে তো ওই ভাবে সরব হলো না মিডিয়া? এখানেও কী তার জন্য নীরবতা। তিনি নীরবে সব কাজ করে গেছেন বলে তার উত্তরাধিকাররা তাকে নিয়ে নীরবই থাকবে? [email protected]
×