ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীর অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২৪ মার্চ ২০১৭

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীর অগ্রযাত্রা

বুধবার ১৫ মার্চ থেকে শুরু হয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পণ্যের মেলা। এসএমই ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত বর্ণাঢ্য এই কার্যক্রম চলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের বিশাল ভবনে। সারা বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় ২০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ২১৬টি স্টলে তাদের নিজস্ব রকমারি পণ্য নিয়ে এই সম্মিলনকে আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন করে রাখে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তাদের ৬৪%-ই হলো নারী। দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার নারীর সফল এবং প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ প্রবৃদ্ধির যেমন নিয়ামক একইভাবে নারীর চলার পথে ও নিরন্তর গতিতে সময়োপযোগী অবদানের শুভযোগ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন এবং এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নারী জাতির সামনে যাওয়ার পথকে অবারিত করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের পুরো কর্মযজ্ঞে তাদের অভাবনীয় সাফল্যও আজ সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসব উদ্যোক্তা নিজস্ব অর্থায়ন এবং শ্রমশক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে যে সব দেশজ পণ্যসামগ্রী দর্শনার্থীদের সামনে হাজির করে তা যেমন িৈশল্পক বৈভবে সমৃদ্ধ একইভাবে আপন উৎপাদন শৈলীতেও নানামাত্রিকে উদ্ভাসিত। অর্থাৎ অঞ্চলভেদে প্রতিটি পণ্য সম্ভারে আছে নিজস্ব ঐতিহ্যিক এবং পারিপার্শ্বিক বৈশিষ্ট্য। যেমন যশোরের সুতার কাজ করা নিপুণ কারুকার্য আর রংপুরের শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজে বুনা মিহি সুতার চমৎকার আলপনা একেবারেই ভিন্নমাত্রার। একইভাবে সিলেটের মণিপুরী তাঁতের সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম থেকে অনেকটাই আলাদা রাজশাহী রেশম শিল্পের বাহারি পণ্যের অন্য রকম বৈভব। আর রাজধানী ঢাকার হরেক রকম ফ্যাশন হাউসের নিজস্ব নির্মাণশৈলীর যে চমৎকার অভিনব সামগ্রী তা তো সবারই নজর কাড়ার মতোই দৃষ্টিনন্দন। তার ওপর স্টলে দৃশ্যমান হয় নিজের তৈরি করা পণ্যের পশরা সাজিয়ে উদ্যোক্তারা ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। এমনই কয়েক নারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় কি ভাবে তারা দেশজ পণ্য উৎপাদনে নিজেদের যুক্ত করলেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েও কোন সরকারী-বেসরকারী কিংবা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় পেশাকে কেন নিলেন না? প্রথমেই আসে এমন একজনের নাম যিনি একাধারে উদ্যোক্তা এবং পাশাপাশি একটি সম্মানজনক পেশায়ও যুক্ত আছেন। তার নাম সাজিদা ইসলাম পারুল। তিনি একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার। ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজ থেকে সমাজকর্ম বিভাগে সম্মানসহ স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। আবার নিজের স্বল্প পুঁজি মাত্র ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ‘শাড়ীঘর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও তৈরি করেছেন। এখানে শাড়ি থেকে আরম্ভ করে সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়াসহ অন্য পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হয়। সামান্য পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করলেও এখন তার প্রতিষ্ঠানে প্রায়ই ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সবই নিজের শ্রমে অর্জিত ব্যবসায়িক মুনাফা থেকে। পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তার ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন। অন্যান্য নারীকেও এই শিল্পে যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের খরচ সামলিয়ে বাকি মুনাফা পুঁজি করে পুনরায় তা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছেন। পাশাপাশি সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন বুটিক হাউসে যেখান থেকে তিনি তার শিল্পকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ যোগাড় করতে পারেন। আরও একজন সফল উদ্যোক্তা রওশন আরা আক্তারী বীথি, তিনিও ইডেন গার্লস কলেজ থেকে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বামী কর্পোরেট পেশায় নিযুক্ত। ভেতরের অদম্য ইচ্ছে থেকেই এই শিল্পকর্মে যুক্ত হয়েছেন। উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার পরও কোন প্রতিষ্ঠানে পেশাজীবীর ভূমিকায় না গিয়ে ব্যবসায় কেন জড়ালেন? তার মতে ব্যবসা একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। নিজের মতো কাজ করা থেকে শুরু করে সংসার, ধর্ম পালন এমনকি সন্তানের লালন-পালনেও কোন ধরনের বিঘেœর সৃষ্টি হয় না। সামান্য দেড় লাখ দিয়ে ব্যবসার যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে আরও ৩ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসায় পুঁজি খাটাচ্ছেন। আয় যা হয় তা সংসারের কাজে না লাগলেও শিল্প পণ্যের প্রসার বাড়তে থাকে। এসব শিল্পোদ্যাক্তা মূলত শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জামি, ফতুয়া, কার্পেটসহ বাহারি পণ্য দেশীয় কাঁচামালে তৈরি করে বাজারজাত করার চেষ্টা করেন। তাদের বক্তব্য তারা সফলও হচ্ছেন। পণ্য সম্ভার শুধু তৈরি করা নয়, তা ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয়াও অনেক বড় দায়িত্ব। প্রতিযোগিতার যুগে এই দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে যায়। শিল্প পণ্যের গুণগত মানের দিকেও অনেক বেশি নজর দিতে হয়। তা না হলে বাজার হারানোর আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ প্রত্যেকেই উৎপাদন সামগ্রীর উন্নত মান নিয়ে বিশেষ ভাবে সচেতন এবং উদ্বিগ্নও। মেলায় দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড়ে পুরো আয়োজন জুড়ে যে আনন্দযোগের অবতারণা হয় তা যেমন মনোজ্ঞ একইভাবে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যেরও একটি গতিশীল সম্ভাবনার দিকনির্দেশক। দেশের ভোক্তা শ্রেণীর প্রয়োজন মিটিয়েও এসব সমৃদ্ধ পণ্য বাইরে পাঠানো যায়। যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করবে। আরও একজন ক্ষুদে উদ্যোক্তা আলেয়া ইয়াসমিন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। স্বামী সরকারী কর্মকর্তা। সেই সুবাদে সারা বাংলাদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা। ফাঁকে ফাঁকে নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যান। একসময় স্নাতক ডিগ্রীও আয়ত্তে আসে। ২ ছেলে ও ১ মেয়ে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে মেয়েও এই শিল্পেকর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। ধানম-ির রাপা প্লাজায় তাদের হস্তশিল্পের শোরুম আছে ‘জয়িতা’ নামে। সেখানে নানা রকম হাতে বোনা নির্মাণশৈলী বুটিক হাউসকে যেভাবে দর্শনীয় করে রাখে সে অনুভূতিও এক অন্যরকম আনন্দ। প্রথমেই নিজের অল্প অর্থায়নে যে শিল্পের নির্মাণাগার গড়ে তোলেন সেখানে আজ পুঁজির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা। তিল তিল করে হাতে তৈরি এই বুটিক শিল্পকর্মটি নিজের পরিশ্রমের এক অনন্য নির্মাণসৌধ। যা ভাবতে গেলে এক পরমানন্দ তাকে তৃপ্তির শীর্ষে নিয়ে যায়। নারীরা আজ পিছিয়ে নেই কোন ভাবেই। মেয়েরা একসময় লেখাপড়া শিখে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিত। পরবর্তীতে তা বিস্তৃতি লাভ করে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা আইনজ্ঞ হিসেবেও নারীর ভূমিকা সব সময়ই উল্লেখ করার মতো ছিল। আর রাজনীতিতে বাংলাদেশের ‘নারীরা প্রায়ই ৩ দশক ধরে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে যাচ্ছেন। কৃষি অর্থনীতিতে নারীশ্রমের বিকল্প নেই। পোশাক শিল্পে নারীর যুগান্তকারী ভূমিকা এই খাতের মূল শ্রমশক্তি। বাকি ছিল শুধু ব্যবসা বাণিজ্য আর শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে সফল নারীর আর এক মাত্রা যোগ হওয়ার। পর পর হয়ে যাওয়া কয়েকটি শিল্পপণ্য মেলা নারীর এই অব্যাহত অগ্রযাত্রাকে দেশের সমৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে স্পষ্ট করেছে।
×