ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্যের সোনারোদে বিশ্বসেরা সাকিব

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৭

সাফল্যের সোনারোদে বিশ্বসেরা সাকিব

মানুষের জীবন অনেকটা নাটকের মতো। ক্ষণে ক্ষণে ঘটে পটপরিবর্তন। কখনও সাফল্য, কখনও ব্যর্থতা, কখনও বা আলো আবার কখনও বা অন্ধকার। প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির যোগফল না মিললেই নেমে আসে ঘোর অমানিশা। এমন দুর্যোগের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা অবলীলায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। নিজের কাজে পারিপার্শ্বিক কোনকিছুই প্রতিবন্ধক হতে পারে না। সচেতন সবাই বিশ্বাস করেন, এমন লৌহ মানসিকতার মানুষেরাই দুনিয়াতে বাজিমাত করেন। নিজেকে নিয়ে যান সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৌঁছে যান আকাশছোঁয়া উচ্চতায়। অনেকের মধ্যে এমন একটি প্রিয় নাম সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের অহংকার, গৌরব। তারকা এই অলরাউন্ডারের অতিমানবীয় কীর্তিতে বাংলাদেশের নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ক্রিকেটবিশ্বে। কারও কাছ থেকে দুঃখ বা কষ্ট পেলে অনেকেই মুষড়ে পড়েন। প্রভাব পড়ে তার ব্যক্তিজীবন বা কর্মজীবনে। কিন্তু সাকিব আল হাসান এসবে ধার ধারেন না। কোন কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারে না। কষ্টের যাতনা আছে তার মধ্যেও, দুঃখ পেলে মন খারাপ হয়। কিন্তু অদম্য মানসিকতার সাকিব এসবকে পাত্তা দেন না। নিজের কাজটা করে যান নিষ্ঠার সঙ্গে। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ক্রিকেট মাঠে এমনই করে চলেছেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। ক্রিকেট সাকিবের কাছে ইবাদতের মতো। মাঠ তীর্থস্থানের মতো। দেশের পতাকা সমুজ্জ্বল রাখতে যেকোন মূল্যে তিনি আপোসহীন। অনেক সমালোচনা, দুঃখ, কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু তাতে কর্ণপাত করেননি মাগুড়ার ছেলে। সবকিছু পেছনে ফেলে মাঠে নিজেকে উজাড় করে দেন সবসময়। দিনের পর দিন তিনি যা করে চলেছেন তাতে তাকে ভিন্ন জগতের মানুষের মতোই মনে হয়। লঙ্কাভূমে বাাংলাদেশের ঐতিহাসিক শততম টেস্টে আরেকবার এ প্রমাণ রেখেছেন। সাকিবের অসাধারণ কীর্তিগাথার কল্যাণেই ১০০তম টেস্ট ম্যাচটি জিতে ইতিহাস গড়েছে লাল-সবুজের দেশ। ধারাবাহিক চোখ ধাঁধানো পারফর্মেন্স প্রদর্শন করে হয়েছেন সিরিজের সেরা ক্রিকেটার। অথচ তিন বছর আগে শৃঙ্খলাজনিত কারণে সাকিবকে দেয়া শাস্তির পর কত কথাই না বাতাসে ভেসেছে। অনেকেই বলেছেন, খেলা ছেড়ে সাকিব পাড়ি জমাবেন যুক্তরাষ্ট্রে। টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন না, খেলবেন শুধু ওয়ানডে ও টি২০। কিন্তু এসব যে ভিত্তিহীন সে প্রমাণ মিলেছিল সাকিবের আবেদনের মধ্য দিয়ে। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০১৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে খেলার অনুমতি পান সাকিব। বিসিবি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে হয়ত অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ফিরেই জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে অতিমানবীয় পারফর্মেন্স প্রদর্শন করেন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার। সব বিতর্ক পেছনে ফেলে মাঠের লড়াইয়ে আবারও নিজেকে সেরা হিসেবে দাঁড় করানোর পর সাকিব বলেছিলেন, ‘যখন খেলতে নামি, তখন কোন কিছুই আমার মাথায় থাকে না। আমি জানি, যত দিন মাঠে থাকব আমাকে ভাল খেলতে হবে, দেশের জন্য খেলতে হবে, পতাকার জন্য খেলতে হবে। বাইরের বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিলে আর এভাবে খেলতে পারতাম না।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জীবনে চলার পথে অনেক কিছুই আসে, ঘটে থাকে। ভাল-মন্দের মিশেল থাকে। এসবের সঙ্গে নিজের ক্যারিয়ার যারা গুলিয়ে ফেলেন তাদের সমস্যা হয়। আল্লাহর রহমতে বাইরের কোন কিছু আমার খেলায় প্রভাব ফেলতে পারে না।’ এই হলো সাকিব। এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতার কারণেই শত ঝঞ্ঝা, বাধা পেরিয়েও আজ তিনি সেরার সিংহাসনে। শততম টেস্টের আগেও সাকিবের বোলিং সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বাংলাদেশ কোচ চন্দ্রিকা হাথুরুসিংহে। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের বোলিংয়ে আগের মতো ধার নেই বলে দাবি করেছিলেন তিনি। মানে তার বোলিং অনেকটাই নির্বিষ। অথচ সেই সাকিবই কিনা ব্যাট হাতে দারুণ একটি সেঞ্চুরি করার পর বল হাতেও দারুণ সাফল্য পেয়েছেন। কলম্বোয় দুই ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের জয়ে রেখেছেন বিশাল অবদান। এই দারুণ সাফল্য পেয়ে কোচকে ভালই জবাব দিয়েছেন এই বাঁহাতি অলরাউন্ডার। এরপর সংবাদ সম্মেলনে অনেকটা হাসির ছলে সাকিব বলেন, ‘হয়ত তিনি (চন্দ্রিকা হাথুরুসিংহে) এখন বলবেন সাকিব আগের মতোই বল করছে। এখন সে সেরা বোলার।’ নিজের বোলিং সামর্থ্য নিয়ে বিশ্বের সেরা এই অলরাউন্ডার বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি সব সময়ই চেষ্টা করি নিজের সেরাটা দেয়ার জন্য। কখনও সাফল্য পাই, আবার কখনও ব্যর্থ হই। হয়ত এই ম্যাচে ভাল করেছি, বলা যায় আগের মতোই বল করছি।’ এরপর কোচ নিজেও সাকিবের প্রশংসা করেছেন, ‘এই ম্যাচে সাকিব দারুণ বোলিং করেছে। মুস্তাফিজ যখন একদিক থেকে ভাল বোল করছিল, অন্যপাশে সাকিব তখন রানটা আটকে রেখেছে। এটা দলের জয়ে খুবই ভাল হয়েছে।’ বাংলাদেশের সফলতার সমার্থক শব্দ হয়ে উঠছেন সাকিব। শততম টেস্টের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পর শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের জয়টাকে একেবারে নিশ্বাস দূরত্বে নিয়ে চলে আসেন সাকিব। এই টেস্টে ছয় উইকেট নিয়ে আরেকটি দারুণ মাইলফলক স্পর্শ করেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার। টেস্ট ইতিহাসের সফলতম বাঁহাতি স্পিনারদের তালিকায় এখন সেরা পাঁচে উঠে এসেছেন সাকিব। রেকর্ড গড়ার দিন ইংল্যান্ডের টনি লককে ছাড়িয়ে যান বাংলাদেশের সেরা তারকা। ১৯৬৮ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া লক ৪৯ টেস্টে নিয়েছিলেন ১৭৪ উইকেট। কলম্বো টেস্টে ৬ উইকেট নেয়ায় ৪৯ টেস্টে সাকিবের উইকেট সংখ্যা ১৭৬। তবে এ তালিকায় সবার ওপরে এই টেস্টে সাকিবের প্রতিপক্ষ ও লঙ্কান অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথ। এখন পর্যন্ত ৮০ টেস্টে ৩৭২ উইকেট নিয়েছেন হেরাথ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টরি। ১১৩ টেস্টে ৩৬২ উইকেট নেন ভেট্টরি। ক্রিকেটীয় ভাষায় বললে, সাকিবের নাকি ম্যাচিউরিটি ও টেম্পারমেন্টের অভাব। কেবল তাই নয়, বিপদের সময় নাকি তার ব্যাট হাসে না। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের বিরুদ্ধে এগুলো সমালোচকরা অহরহই বলে থাকেন। নিউজিল্যান্ড সিরিজে ডাবল সেঞ্চুরির পর ভারতের বিরুদ্ধে একমাত্র টেস্টেও ব্যাট হাতে খারাপ করেননি সাকিব। তবে গল টেস্টের দুই ইনিংসে রান না পাওয়ায় শুরু হয়ে যায় সমালোচকদের সমালোচনা। বাংলাদেশের ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাবিরাও সাকিবের ব্যাটিংয়ের সমালোচনা করেন। চারপাশ থেকে ভেসে আসা সমালোচনাগুলোকে ব্যাট দিয়েই সীমানা ছাড়া করেন সাকিব। লঙ্কানদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দেন তিনি। চলতি বছর ডাবল সেঞ্চুরি ও তিন হাফ সেঞ্চুরিতে একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৫০০ রানের কোটা পার করেছেন সাকিব। অনবদ্য পারফর্মেন্সের পর প্রশংসার স্র্রোতে ভাসছেন তিনি। সাকিবের অর্জন আনন্দিত করেছে আইপিএলের দল কলকাতা নাইট রাইডার্স ও তার টিম ম্যানেজম্যান্টকেও। গত সোমবার এক টুইটে কলকাতা নাইট রাইডার্স সাকিবকে অভিনন্দন জানিয়েছে। নিজেদের অফিসিয়াল টুইটার পেজে কেকেআরের টুইট করে। তৎক্ষণাৎ ওই টুইটটি নিজের পেজে রিটুইট করেন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। সেঞ্চুরি করেই মূলত সমালোচনার জবাব দেন সাকিব। এর পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পোস্ট দেন সাকিবের স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির। সাকিব নিজের জন্য খেলে এই সমালোচনার জবাবে শিশির বিদ্রƒপ করে লিখেন, ??‘আরেকটি অপরাধ করলে। প্লিজ এই ১০০ রান বাসায় নিয়ে এসো যাতে আমরা সেগুলো দিয়ে তরকারি রেঁধে খেতে পারি। তুমি তো নিজের জন্য খেল। নিশ্চয়ই তুমি ভাল কিছু করোনি।’ ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো আইসিসি ওয়ানডে অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করেন অলরাউন্ডার সাকিব। এটি ছিল বাংলাদেশী কোন ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। তবে ২০১১ সালের এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াটসনের কাছে শ্রেষ্ঠত্ব হারান তিনি। ৬ মাস পর অক্টোবরেই শীর্ষস্থান পুনর্দখল করেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক। এরপর ২০১২ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে আবারও ওয়াটসনের কাছে শীর্ষস্থান হারান সাকিব। সেবার হারানো মুকুট ফিরে পেতে বেশি সময় নেননি বাংলাদেশের সবচেয়ে কার্যকরী ক্রিকেটার। মাত্র ১৫ দিনের মাথাতেই সেই ওয়াটসনকে হটিয়ে আবারও ওয়ানডে অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ান জায়গা নিজের দখলে নিয়েছিলেন আমাদের লাল-সবুজের অহংকার। এরপর মাঝেমধ্যেই উত্থান-পতন হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে বিস্ফোরক পারফর্মেন্সে আবারও সিংহাসনে উঠেছেন ২৯ বছর বয়সী সাকিব।
×