ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

খোন্দকার মহিতুল ইসলাম

দেখে এলাম কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

দেখে এলাম কোল্লাপাথর শহীদ স্মৃতিসৌধ

দিনটি ছিল ২৭ নভেম্বর রবিবার, ২০১৬। ঢাকার গ্রিন ট্যুরিজমের পক্ষ থেকে আমরা নয়জন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবায় এলাম। ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতি ট্রেনে যাত্রা। ফিরলাম মহানগর গোধূলি ট্রেনে। দেশের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থান দেখার এ সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে আমাদের টিমের সকল সদস্য আনন্দিত। আর এজন্য যাকে কৃতিত্ব দিতে হয়, তিনি হলেন আমাদের টিমলিডার বেণুবর্ণা অধিকারী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যারা আমাদের স্বাধীনতা এনেছেন, তাদের মধ্যে এখানে ৫০ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা চিরনিদ্রায় শায়িত। তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমরা এখানে এসেছি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা শহীদ হন। সমাধিস্থলের চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার উঁচু-নিচু টিলা, নানা প্রজাতির বৃক্ষ, সামাজিক বনায়ন আর সবুজের সমারোহ পর্যটকদের চোখে পড়ে। সমতল ভূমি থেকে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি মাড়িয়ে মূল বেদিতে পা রাখার পর হাতের বাঁয়েই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সারিবদ্ধ কবর। এখানে যাঁরা ঘুমিয়ে আছেন, সেই ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা হলেন : সিপাহী দর্শন আলী, জাকির হোসেন, আবদুল জব্বার, হাবিলদার তৈয়ব আলী, নায়েক আবদুস সাত্তার, সিপাহী আব্বাস আলী, ফারুক আহম্মদ, ফখরুল আলম, মোজাহীদ নূরু মিয়া, নায়েক মোজাম্মেল হক, নায়েক সুবেদার আবদুস ছালাম, নোয়াব আলী, সিপাহী মোসলেম মৃধা, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, আবদুল অদুদ, সিপাহী আজিমউদ্দিন, মতিউর রহমান, মোশারফ হোসেন, নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলাম, সিপাহী নূরুল হক, আবদুল কাইয়ুম, সিপাহী হুমায়ুন কবির, ল্যান্স নায়েক আবদুল খালেক, ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, তারু মিয়া, নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন, রফিশতল ইসলাম, মোর্শেদ মিয়া, আশুতোষ রঞ্জন দে, তাজুল ইসলাম, শওকত, আবদুস ছালাম, জাহাঙ্গীর, আমির হোসেন, পরেশচন্দ্র মল্লিক, জামাল উদ্দিন, আবদুল আওয়াল, আবেদ আহাম্মদ, সিরাজুল ইসলাম, ফরিদ মিয়া, মতিউর রহমান, শাকিল মিয়া, আবদুর রশিদ, আনসার এলাহী বক্স, সিপাহী শহীদুল হক, সিপাহী আনোয়ার হোসেন, আবদুল বারী এবং অজ্ঞাত তিনজন। ওই সমাধিস্থলে রয়েছে নায়েক সুবেদার মইনুল ইসলামের কবর। তার নামেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকার অতি পরিচিত মইনুল সড়ক নামকরণ করা হয়েছে। এ সমাধিতে ৫০ জনের নাম রয়েছে। এরমধ্যে ৪৭ জনের পরিচয় মিলেছে। অন্য তিনজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। কথা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিমের সাথে। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ৬ জুন থেকে ওই বছরের সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে যারা গেরিলা যুদ্ধ ও সম্মুখ সমরে শহীদ হন, তাদের মধ্যে এই ৫০ জনের মরদেহ পরম শ্রদ্ধায় তার পরিবারের সদস্যরা এখানে সমাহিত করেন। ৫ ডিসেম্বর এ এলাকা দখলদারমুক্ত হয়ে যায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন জেলা প্রশাসন কোল্লাপাথর শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত কবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৮০ সালে সেখানে একটি কাঠের তৈরি রেস্টহাউস হয়। গত একদশকে সেখানে স্মৃতিসৌধ, মসজিদ, রেস্টহাউস, সীমানাপ্রাচীর ও পুকুরঘাট বানানো হয়। প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ এই কাজ শেষ করে। কথা প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম বললেন, এটা তাদেরই পারিবারিক জায়গা। স্মৃতিসৌধের জন্য তারা ৬৫ শতাংশ জমি দান করেন। তাদের পরিবার দেশকে উৎসর্গ করেছে এ জায়গা। একটি ছোট টিলার ওপরে এই সমাধিস্থল। কসবা বাংলাদেশের একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা যা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় ছিল এবং এর পাশে ভারতের আগরতলা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থাকার কারণে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল। ফলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে এ এলাকায় বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এখানে দু’জন বীরবিক্রম, একজন বীরউত্তম, দু’জন বীরপ্রতীকসহ মোট ৪৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এখানকার প্রতিটি কবরের ওপরেই লেখা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাম এবং ঠিকানা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম এবং তার আত্মীয়রা মিলে তাদের জায়গার ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ সংগ্রহ করে দাফন করেন। তিনি বলেন, সরকার এখানে একটি পরিপূর্ণ শহীদ স্মৃতিসৌধ করবে। এ প্রকল্পে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুমোদন রয়েছে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসবেন এখানে। দেখবেন, কি অপরিসীম আত্মত্যাগের ফসল আমাদের বাংলাদেশ। তাদের থাকার জন্য রেস্টহাউসের সুবিধা থাকবে। এখানে গড়ে তোলা হবে একটি জাদুঘর। আবদুল করিম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টরটি ছিল সবচেয়ে বড়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ। এই সেক্টরের মাধ্যমে মোট ২২৬টি অপারেশন হয়। এখানকার আশেপাশে ১১৫৫ জন শহীদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সরকার চাইলে একত্রিত করতে পারেন এখানে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানর এক অনন্য নিদর্শন হোকÑ এই স্মৃতিসৌধ। কোল্লাপাথরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলে সরকারী বা রাজনৈতিক দলের কোন কর্মসূচী না থাকলেও স্থানীয় এলাকাবাসী তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেন না। মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শহীদদের আত্মীয়-স্বজনদের আগমন ঘটে এখানে। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে কোল্লাপাথর স্মৃতিসৌধ এলাকাকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব তাজ মোহাম্মদ আমাকে জানান, নিজ কর্মকালীন সময়ে তিনি ঐতিহাসিক কোল্লাপাথর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কবর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। কিন্তু এজন্য তাকে অনেক গঞ্জনা সইতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার দফতরে সচিবকে তলব করেন। তিনি রীতিমত ক্রুদ্ধ হন তার ওপর। চিৎকার করে বলেন, কেন আপনি সেখানে গেলেন? আপনাকে কে বলেছে সেখানে যেতে? তাজ মোহাম্মদ বলেন, খালেদা জিয়া সেদিন কেন এমন ক্ষেপে গেলেন, আজও আমার কাছে অস্পষ্ট। অথচ, তার স্বামীও একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। এই অঙ্ক মেলান কঠিন। আবার খুব যে কঠিন, তাও নয়। স্বাধীনতার পর বহু মুক্তিযোদ্ধা মা-বাবার কোলে ফেরেনি। তারা কোথায় শহীদ হয়েছে, কোথায় সমাধিস্থ হয়েছে জানা যায়নি। শোকার্ত অনেক মা-বাবা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সন্তানের কবর খুঁজতে কোল্লাপাথর ছুটে আসে। যত্ন করে নাম, ধাম, ঠিকানা মিলিয়ে দেখে। শেষতক না পেয়ে চোখের পানি ফেলে সব শহীদদের জন্য সম্মান প্রদর্শন করে করে কাঁদতে কাঁদতে ধীর পায়ে চলে যায় বুক ভরা কষ্ট নিয়ে। অথচ এদেশেই কিছু কুশ্মা- দেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে ইয়ার্কি করে। রগড় করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের এমন এক স্মৃতিসৌধ দেখতে যেতে পারেন আপনিও। হলফ করে বলতে পারি, এটা হবে অশ্রুসিক্ত নয়নে একবুক ভালবাসা ওদের জন্য রেখে আসার এক মাহেন্দ্রক্ষণ।
×