ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিলেটে বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন

মতিলাল দেব রায়

প্রকাশিত: ২০:৫১, ১৯ জুলাই ২০২২

সিলেটে বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন

বন্যা

সিলেট শহর ও সংলগ্ন গ্রামগুলো বন্যার পানিতে বারবার প্লাবিত হওয়ায় সিলেটের জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছেসিলেট শহরে এর আগে আমরা কোনদিন বন্যা হতে দেখিনিআশ্চর্যের বিষয় এবারের বন্যায় সিলেটবাসীকে এক অসহায় পরিস্থতিতে ফেলে দেয়, যার মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়েছিলসিলেট শহরের মানুষকে নৌকা ভাড়া করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হবে, যা কল্পনার মধ্যেও ছিল নাসিলেটে বন্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে আবহাওয়া বিভাগ থেকে কোন পূর্বাভাসও দেয়া হয়নিবন্যার সময় সিলেট ও আশপাশের গ্রামগুলো যখন পানিতে ভাসছিল তখনও কাউকে একটি লাইফ সেভিং জ্যাকেট পরিধান করতে দেখিনি

বন্যার পর ত্রাণ দেয়ার জন্য হেলিকপ্টার নামার মতো কোন জায়গা পাওয়া যায়নিতাই সরকারী সাহায্য বিপর্যস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিলম্ব হয়ে যায়সিলেট শহরের এবং শহরতলীর মানুষ খুব কষ্টে দিন যাপন করছেনসবচেয়ে কষ্টে দিন যাপন করছেন স্বল্প আয়ের মানুষবন্যার কারণে রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, ঠেলাগাড়ি চালক, ছোট অনেক ধরনের যানবাহন না চলার কারণে বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষ

তাদের ঘরে না আছে খাবার, না আছে খাবার কেনার সামর্থ্যতারা দিনে শ্রম বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করে।  অন্যদিকে বিত্তবানরা অর্থ থাকলেও বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি  পাওয়া না যাওয়ায় দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দামের কারণে ক্রয় করতেও পারছেন নাএর ওপর যাতায়াতের ভোগান্তি

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেটের বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্রটিতাই সিলেট শহরে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুত চলমান আছেচতুর্দিকে নলকূপ ও পানির অন্যান্য উস বন্যার পানিতে এখনও অনেক স্থানে ময়লা পানির নিচে রয়েছেঅনেক অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য এ্যাম্বুলেন্স বা অন্যান্য যানবাহন পাওয়া যাচ্ছে নাশহরতলীর অনেকের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছেসিলেটের বিভিন্ন পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী সকলেই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন

সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যেমন বংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী বন্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসি এবং পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করার কাজে রয়েছেবিমানবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণসামগ্রী দুর্গম এলাকায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেকিছু সংগঠন সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছেইতোমধ্যে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছেকিন্তু রয়ে গেছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন, বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট, ব্রিজঅনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছেঅনেকের মস্য খামার বন্যার পানিতে ভেসে গেছে

সিলেট শহরের বন্যা প্রত্যাশিত ছিল নাকারণ দীর্ঘ এক শবছরেও সিলেট শহর বন্যাকবলিত হয়নিতাই বন্যা মোকাবেলা করার জন্য সরকার, বেসরকারী সংগঠন বা সচেতন সমাজ কারও কোন আগাম প্রস্তুতি ছিল নাসিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় সকল উপজেলা বন্যাকবলিত হয়েছেতাই এই সকল এলাকাতে সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরীএই পরিকল্পনায় প্রাথমিক অবস্থায় যাদের খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন তাদের আগামী ছয় মাস পর্যন্ত খাদ্য সহায়তা দিয়ে যেতে হবেযাতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে

এ ব্যাপারে প্রয়োজনে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহযোগিতা নেয়া যেতে পারেযে সকল পরিবারের নলকূপ বন্ধ হয়েছে বা অচল হয়ে গেছে তা অবিলম্বে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস থেকে জরিপ করে ক্ষতিগ্রস্ত নলকূপের বর্ণনা দিয়ে একটি রিপোর্ট জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী কার্যালয়ে জমা দিলে এবং এর একটি কপি জেলা ইউনিসেফ প্রতিনিধিকে পাঠালে তারা অচল নলকূপগুলো সচল করার একটি ব্যবস্থা করতে পারবেএ ব্যাপারে প্রত্যেক জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস থেকে নলকূপ মেরামতের জন্য ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবেপ্রয়োজন হলে জেলা কার্যালয় অথবা ইউনিসেফ থেকে আনার ব্যবস্থা করতে হবেকোন কোন নলকূপ পুনরায় পাইপ তুলে এনে বাড়ির অন্যস্থানে বসাতে হবেতাই সরকারকে রিসিংকিং-এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবেসিলেট এবং সুনামগঞ্জকে বন্যাদুর্গত এলাকা হিসেবে সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে

সিলেট এবং সুনামগঞ্জের সব হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ডাক্তার, নার্সসহ অন্য সহকারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিতে হবেবন্যাকবলিত এলাকার সকল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবেউপজেলাগুলোতে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীদের ওষুধ সরবরাহ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে

সরকারের দেয়া শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারেও উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীগণকে সার্বক্ষণিক ফলোআপ করতে হবেকোন অবস্থায় শিশুদের টিকাদান কর্মসূচী বন্ধ করা যাবে নামনে রাখতে হবে শিশুরাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম

এবার সিলেটে বন্যা হওয়ার অনেক কারণ আছে বলে পরিবেশকর্মীরা বলছেনসিলেটের অধিকাংশ নদী ও ছড়া বালি/মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছেউজানে মেঘালয় ও অসমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে উজানের পানি বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হয়তাই অতিরিক্ত পানি ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে নদীগুলো ধারণ করতে না পারায় বন্যার সৃষ্টি হয়অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দীর্ঘদিন যাবত পাহাড় কেটে মাটি পাচার হওয়ায় পাহাড় ধস, অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন, সিলেট শহরের ময়লা-আবর্জনা ও বর্জ্য ফেলার কারণে সুরমা নদীর গতি আর আগের মতো নেইনদীর নাব্য হারানোর কারণেই বন্যার পানি ধরে রাখতে পারে নাতাছাড়াও সিলেট শহররক্ষা কোন বাঁধ না থাকার কারণে এবং দেশের জলবায়ু পরিবর্তনও বন্যার অন্যতম কারণ বলে অনেক পরিবেশবাদী বলে থাকেন

আগামীতে স্থায়ী বন্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে কয়েকটি পরামর্শ রাখছিএক- নেদারল্যান্ডসের রাজধানী শহর এ্যামস্টারডাম সমুদ্রের কাছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থানের কারণে বন্যা থেকে এ্যামস্টারডাম শহরকে রক্ষা করার জন্য সম্পূর্ণ শহরের চতুর্দিকে বাঁধ নির্মাণ করে শহরবাসী এবং শহরকে শত বছর আগে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়সেইরকম সিলেটকে রক্ষা করার জন্য স্থায়ী সিলেট রক্ষাবাঁধ দেয়ার জন্য একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবেদুই- সিলেট এবং সুনামগাঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকায় হঠা করে আসা বন্যা থেকে বাঁচার জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে কয়েকটি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করার পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে জরুরী প্রয়োজনে রান্না করার ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি ও এক শভাগ সেনিটাইজড স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা থাকবে

তিন- দুর্যোগের সময় জরুরী অবতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক বন্যা লেভেলের ওপরে উচ্চতাসম্পন্ন হেলিপ্যাড তৈরি করে রাখতে হবেচার- বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরী ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর জন্য কয়েকটি স্পিডবোট সিটি কর্পোরেশনে সর্বক্ষণ সংরক্ষণ রাখতে হবেপাঁচ- নদীতে আবর্জনা ফেলা, যত্রতত্র পাহাড় কাটা, অতরিক্ত পাথর উত্তোলন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং বনাঞ্চলে গাছকাটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবেছয়- সিটি কর্পোরেশনে পর্যাপ্ত লাইফ সেভিং জ্যাকেট মজুদ রাখতে হবে

 

লেখক : গবেষক

×