ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ঈদ-উপহার টাইগারদের

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৩১ আগস্ট ২০১৭

অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ঈদ-উপহার টাইগারদের

মিথুন আশরাফ ॥ সাকিব আল হাসান যে মহারত্ম তা বুঝিয়ে দিলেন। অস্ট্রেলিয়ার দুই ইনিংসকে ধসে দিলেন। তাতে করে বাংলাদেশও প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারাল। সাড়ে তিনদিনেই খেলা শেষ হয়ে গেল! মিরপুর টেস্টে ২০ রানে জয় পেল বাংলাদেশ। ইতিহাস রচনা করল। জিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজেও ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল। এখন চট্টগ্রামে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া দ্বিতীয় টেস্টে জিতলে অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশই করে দেবে বাংলাদেশ। একটি ভাল বলের অপেক্ষা ছিল। সেই ভাল বলে একটি আউটের অপেক্ষা ছিল। সবারই জানা ছিল চতুর্থদিনে আউটের শুরু হলে তা আর থামবে না। সেই আউটটি সাকিবের বলে শুরু হলো। এরপর যে অস্ট্রেলিয়া ইনিংসে ডায়রিয়া লাগল, দেখতে দেখতেই ২৪৪ রানে অলআউট হয়ে গেল অসিরা। তৃতীয়দিন শেষে অস্ট্রেলিয়ার জিততে ১৫৬ রানের দরকার ছিল। বাংলাদেশের দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়া টার্গেট অতিক্রম করার আগেই ৮ উইকেট। তাতে বাংলাদেশই সফল হলো। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২৬০ রান করেছিল। এর জবাবে প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া ২১৭ রানের বেশি করতে পারেনি। তখনই সবার বোঝা হয়ে যায় যদি কোনভাবে অসিদের ৩০০ রানের কাছাকাছি টার্গেট দেয়া যায় তাহলেই জয় আসবে। বাংলাদেশ স্পিনারদের যে খেলতেই পারছে না অস্ট্রেলিয়া ব্যাটসম্যানরা। দ্বিতীয় ইনিংসে ২২১ রান করে অস্ট্রেলিয়ার সামনে ২৬৫ রানের টার্গেট দাঁড় করাল বাংলাদেশ। টার্গেট কম হয়ে গিয়েছিল। আবার যখন তৃতীয়দিন শেষে ২ উইকেট হারিয়ে ১০৯ রান করে ফেলেছিল অসিরা, ওয়ানার ও স্মিথ ব্যাট হাতেও থাকেন, তখন যেন হারের সম্ভাবনাও জেগে উঠেছিল। তবে এটাও জানা ছিল একবার উইকেট পড়া শুরু করলে, ওয়ানার ও স্মিথের জুটি ভাঙ্গা গেলে, জয় মুঠোয় এসে পড়বে। তাই হলো। তৃতীয়দিন ওয়ার্নার ও স্মিথ দুইজনই ‘নতুন জীবন’ পেয়েছেন। সেই ‘জীবন’ পেয়ে আতঙ্কও ছড়ান। চতুর্থদিনেও দুইজন মিলে সাবলীলভাবেই এগিয়ে চলছিলেন। আগেরদিন ৭৫ রানে অপরাজিত থাকা ওয়ার্নার একটা সময় গিয়ে সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। এমনই অবস্থা দাঁড় হয়, ওয়ার্নারের মধ্যে সবাই রিকি পন্টিংয়ের ছাঁয়া দেখতে শুরু করেন। ২০০৬ সালে ফতুল্লা টেস্টেও এমন জয়ের আশা তৈরি করেও পন্টিংয়ের সেঞ্চুরিতে যে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এবারও কী তেমন কিছুই হবে? এমন প্রশ্ন যখন উঠছে তখন এবার সবার ভেতরই একটি নাম জেগে উঠছে। প্রশ্নও সবার মনে মনে, সাকিব আছেন না। তিনি কী সেটি হতে দেবেন? সত্যিই তাই হলো। অস্ট্রেলিয়া ১৫৮ রানে চলে যায়। জিততে আর ১০৭ রান দরকার। ওয়ার্নার ও স্মিথ মিলে ১৩০ রানের বড় জুটিও গড়ে ফেলেন। এমন সময়েই যেন ত্রাতা হয়ে আসেন সাকিব। ১১২ রান করা ওয়ার্নারকে সাজঘরে ফেরান। তখন স্টেডিয়ামে যেন শুধুই ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’; ‘সাকিব, সাকিব’ রব উঠে যায়। অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের পা কাঁপাও যেন শুরু হয়ে যায়। তারাও যে জানে, যদি এই জুটি ভাঙ্গে তাহলে বাংলাদেশ স্পিনাররা অসি ব্যাটসম্যানদের ঘাড় চেপে ধরবে। চাপ প্রয়োগ করবে। সেই চাপে ব্যাটসম্যানরা ভুল করবেন। আউটও হবেন। ওয়ার্নারকে ফেরালেই হবে না, ফেরাতে হবে স্মিথকেও। কারণ এক আতঙ্ক দূর হলেও আরেক আতঙ্ক যে তখনও উইকেটে আছেন। এ স্মিথ আতঙ্ক, পথের কাটা দূর হওয়া মানে জয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। সাকিব সেই কাজটিও করলেন। পথের কাটাকেই উপড়ে ফেললেন। স্মিথ (৩৭) যখন ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, তখনই যেন অসিদের হারের নিয়তি লেখা হয়ে যায়। এরপর তো মাঝে মাঝে শুধু একটু করে বাধা তৈরি হয়। কিন্তু সেই বাধা সাকিব দূর করেন। তাতে মিরাজ ও তাইজুল মিলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে ২৪৪ রানেই গুটিয়ে যায় অসিরা। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ১০টি উইকেটই বাংলাদেশ স্পিনাররা শিকার করে নেন। সাকিব ৫টি, তাইজুল ৩টি ও মিরাজ ২টি উইকেট তুলে নেন। প্রথম সেশন কোনভাবে অতিক্রম করতে পারলেও দ্বিতীয় সেশনে খুব বেশি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। শেষ ৮ উইকেট ৮৬ রানে হারায়। সেই সঙ্গে জিম্বাবুইয়ে ছাড়া সব দলের বিপক্ষেই হারও হলো অস্ট্রেলিয়ার। ইতিহাসের সেরা বাজে সময় দেখল অসিরা। বাংলাদেশের বিপক্ষে এরআগে দুইবার টেস্ট সিরিজ জিতলেও এবার আর জেতার অপশনই নেই। দ্বিতীয় টেস্ট যদি অস্ট্রেলিয়া জিতেও তাহলে সিরিজ ১-১ ড্র হবে। আর যদি দ্বিতীয় টেস্ট হেরে যায় তাহলে হোয়াইটওয়াশ হবে। যা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে কলঙ্ক হয়েই ধরা দেবে। সেই কলঙ্ক অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের গায়ে জড়িয়ে দিতে পারেন সাকিব। তিনি প্রথম টেস্টে অসাধারণ বোলিং করেছেন। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ৮৪ রান করার পর বল হাতে ৫ উইকেট নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে ৫ রানের বেশি না করতে পারলেও অস্ট্রেলিয়া ইনিংস চুরমার করে দেন। তার স্পিনজাদুতে অসহায় হয়ে পড়েন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা। এ মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ার দুই সেরা ব্যাটসম্যান ওয়ার্নার ও স্মিথকে তো আউট করেনই, সঙ্গে তৃতীয়দিনই খাজাকে সাজঘরে ফেরান। আর ম্যাথু ওয়েড ও আরেক হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান ম্যাক্সওয়েলকেও একই পথের পথিক বানান। ৫ উইকেট শিকার করে নেন। টেস্টে এক ইনিংসে হাফসেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নেন। দুইবার এই কাজ করেন সাকিব। তাতে করে তিনবার এই কৃতিত্ব গড়া রিচার্ড হ্যাডলি থেকে একবার এমন গৌরব অর্জন করা থেকে দূরে থাকেন সাকিব। বাকিরা সবাই সাকিবের পেছনেই পড়ে থাকেন। সাকিব যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এমনিতেই না, তা আবারও প্রমাণ করেন। তার এই অসাধারণ ব্যাটিং অস্ট্রেলিয়াকে একেবারে নাজেহাল করে তোলে। যখনই অস্ট্রেলিয়ার কোন ব্যাটসম্যান ভয় তৈরি করতে থাকেন তখনই সাকিব তাকে সাজঘরের পথ দেখান। আর এরপর উদযাপন তো হয় দেখার মতোই। একেকটি উইকেট নেন এবং প্রতিবারই ভিন্নভাবে তা উদযাপনও করেন। সাকিব এমনই আগ্রাসী হয়ে ওঠেন তাতেই যেন ভীত হয়ে ওঠেন অসি ব্যাটসম্যানরা। তৃতীয়দিন যখন ওয়ার্নার ও স্মিথ ব্যাট হাতে দিন শেষ করেন তখন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। ক্রিকেটারদের মধ্যেও সেই আশঙ্কা ছিল। শেষ পর্যন্ত যদি জেতা না যায়। কিভাবে তাহলে এই জয় আসল? ম্যাচসেরা হওয়া এবং সবার প্রশংসার পাত্র আবারও হওয়া সাকিব সুন্দরভাবে তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, ‘দলের জয়ে কিছু করতে পারায় ভীষণ আনন্দ লাগছে। যারা স্টেডিয়ামে এসে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন তাদের জানাই ধন্যবাদ।’ এরপর সাকিব জয় পাওয়ার আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়ার আসল কাহিনী জানালেন, ‘কারা বিশ্বাস করেছেন জিততে পারব জানি না। কিন্তু বিরতির পর দলের সবাইকে বলেছি, আমরা জিতবে পারব, এ বিশ্বাস তৈরি করতে।’ সঙ্গে তৃতীয়দিন শেষের কথাও জানান সাকিব, ‘গত রাতে আমি বিশ্বাসই করিনি জিততে পারি। কিন্তু আমার স্ত্রী বলেছে তুমি বাংলাদেশকে জেতাতে পার। আমার ভেতর এ বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার স্ত্রী।’ ৫০তম টেস্টে এসে দুর্দান্ত খেললেন সাকিব। সাকিবের ব্যাটিং-বোলিং নৈপুণ্যে বাংলাদেশও ইতিহাস রচনা করা বিজয় তুলে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম টেস্টে হারিয়েও দিয়েছে বাংলাদেশ।
×