ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ফরাসী সঙ্কট দুরারোগ্য ব্যাধি

প্রকাশিত: ০৪:২০, ১৭ জানুয়ারি ২০১৫

ফরাসী সঙ্কট দুরারোগ্য ব্যাধি

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ও এর আশপাশে গত সপ্তাহে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে লাখ লাখ লোক প্রতিবাদ জানায়। এটি সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফরাসীদের নিজেদের মধ্যে সংহতি প্রকাশের জন্য আয়োজিত সবচেয়ে বড় সমাবেশ। ঐসব হামলায় ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি হেবদোর কার্যালয় এবং এক ইহুদী সুপারমার্কেটে ১৭ ব্যক্তি নিহত হয়। কিন্তু ঐক্যের আবেদন ফ্রান্সের বড় বড় শহরের আশপাশের এলাকার অসন্তুষ্ট বাসিন্দাদের বিচ্ছিন্নতাবোধকে কাটিয়ে তাদের মনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। নাবিল সৌদি (২০) বলেন, আমি ফরাসী এবং নিজেকে ফরাসী বলে বোধ করি। কিন্তু এখানে ‘আমি শার্লি’ বলা আপনার জন্য নিষিদ্ধ। তিনি সাময়িকীটির ওপর হামলার পর ঐক্যের ঐ সেøাগানের প্রতি ইঙ্গিত করছিলেন। সৌদি সম্প্রতি এক ট্রেড স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হন এবং মেকানিকের কোন চাকরি পাওয়ার আশা করছিলেন। কয়েক মাস পরও তিনি এখন বেকার এবং বিকল্প পথ খুঁজছেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে শ্লেষের সুরে বলেন, আমি সিরিয়ায় যাব। তার ও অন্য অনেক ফরাসী মুসলিমের মতে, ইসলামী চরমপন্থীদের গত সপ্তাহের হামলা নিয়ে দেশের ব্যতিব্যস্ততায় মৌলিক সামাজিক সঙ্কট থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরে যায় মাত্র। এ সঙ্কট ফ্রান্সের অভিবাসী বসতিগুলোকে কয়েক দশক ধরে ঘিরে রয়েছে। কমিউনিটি নেতা এবং মুসলিম ও উত্তর আফ্রিকানরা অসংখ্য সাক্ষাৎকারে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন যে, প্যারিসে সংঘটিত গত সপ্তাহের হামলা তাদের বসতিগুলোতে আগে থেকেই বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে থাকা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাবে। ফ্রান্সের ১২০ জন মেয়রের এক সমিতি ঐসব হামলার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে উপশহরগুলোর পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ বলে এক বিবৃতিতে সতর্ক করে দেন। তারা বলেন, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা সম্পর্কিত সামস্যাগুলোর সুরাহা করা জরুরী। বাজেট হ্রাস ও কৃচ্ছ্রনীতি অনুসরণের সময় পরিস্থিতির কেবল অবনতিই ঘটেছে। অথচ প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সরকারসহ পরম্পরাগত সরকারগুলো স্কুলগুলোর উন্নতি ও সুযোগ সৃষ্টি করতে বছরের পর বছর ধরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। ঐ ব্যঙ্গ পত্রিকার কার্যালয়ে হামলাকারী সাঈদ কুরাশি ও তার ভাই শেরিফ এবং সুপারমার্কেট অবরোধকারী আমেদি কুলিবানি ফরাসী উপশহরগুলোতেই বড় হয়েছিলেন। তারা তাদের কৈশোরে দৈহিক পরিশ্রমের কয়েকটি কাজও ধরে রাখতে পারেনি। তারা সবাই কমবয়স্ক হওয়ায় ইসলামী চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুসলিম হিসেবে তাদের ঘাতকদের সঙ্গে এক করে দেখা হবে বলে তারা উদ্বিগ্ন। অন্যরা মসজিদ বা অন্যান্য মুসলিম প্রতীকের ওপর প্রতিশোধাত্মক হামলা হওয়া এবং পুলিশী অভিযান চলার আশঙ্কার কথা বলেন। প্রায় সবাই একমত যে, ফ্রান্স ও এর মিত্রদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করাসহ শার্লি হামলার প্রতিক্রিয়া এক বৃহত্তর সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ সমস্যাটি হলো ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিঃস্বতাবোধ। অনেকে একেই তরুণদের চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার মূল কারণ হিসেবে উদ্ধৃত করেন। কমিউনিটি নেতারা বলছেন, ফ্রান্সের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সঙ্কট কর্মসংস্থান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। প্যারিসের রবিবারের বিশাল সংহতি শোভাযাত্রা উপশহর বাসিন্দাদের নিঃস্বতাবোধ দূর করতে পারেনি। কোন কোন উপশহরের বাসিন্দাদের মতে, এটি ছিল এক স্বপ্ন প্রদর্শনী, যার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। এক উপশহরের বাসিন্দা ‘আমি শার্লি’ শোভাযাত্রা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেন। সন্ত্রাসী হামলাগুলো সাজানো ঘটনা বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেন। অনেকে হত্যাকা-ের জন্য হামলাকারীদের কড়া ভাষায় নিন্দা করলেও কার্টুনিস্টরা তাদের উপযুক্ত সাজা পেয়েছেন বলে অন্যরা মত প্রকাশ করেন। কোন কোন উপশহরের তরুণরা বলেন, তারা রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক সুবিধা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এক পৃথক দেশে বাস করে বলে বোধ করে। করিম ইয়াহিয়া (১৫) বলেন, আমি নিজেকে ফ্রান্স থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন বলে অনুভব করি। সে গত বছর দু’বারের বেশি তার উপশহর ছেড়ে যায়নি বলে জানায়। ওলাঁদ গত সপ্তাহের হামলায় নিহতদের স্মরণে ৮ জানুয়ারি ফ্রান্স জুড়ে এক মিনিট নীরবতা পালনে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ফরাসী স্কুলগুলোর কোন কোন মুসলিম ছাত্র তখন দাঁড়াতে অস্বীকৃত জানায়। -ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস।
×