ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা

প্রকাশিত: ২১:০০, ৩ মার্চ ২০২১

স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা

পাকিস্তানের জন্মের ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো সরাসরি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে বাঙালীদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাঞ্জাবি শাসকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের সরকারপ্রধান হতে দিতে রাজি ছিল না। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি বিবৃতি রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। এই বিবৃতিতে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন- ‘এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। আমি বারবার এ কথাই উল্লেখ করেছি, শাসনতন্ত্র কোন সাধারণ আইন নয়, বরং এটা একসঙ্গে বসবাস করার একটি চুক্তি মাত্র।’ রেডিও পাকিস্তানের বরাত দিয়ে এ খবরটি পরদিন ২ মার্চ দৈনিক আজাদ ও দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এই বিবৃতিতে পাকিস্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়ে যায়। একসঙ্গে বসবাস করা না করা সংক্রান্ত ইয়াহিয়ার এই বক্তব্যের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম সুযোগটি গ্রহণ করেন। তিনি এক মুহূর্তও দেরি না করে ১ মার্চ দুপুরেই হোটেল পূর্বাণীতে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন। ইয়াহিয়ার বক্তব্যের উত্তরে তিনি বলেন- ‘ষড়যন্ত্র যদি আরও চলে তাহলে বাংলাদেশ নিজ প্রশ্নের মীমাংসা করে নেবে। আগামী ৭ মার্চ আমি রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করব।’ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার পরক্ষণেই ঢাকার রাজপথে ছাত্র-জনতার মিছিল শুরু হয়ে যায়। মিছিলের স্লোগান ছিল ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ অল্পক্ষণের মধ্যেই পল্টন ময়দানে এক স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাবেক ছাত্রনেতা এবং তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন- ‘আর ৬ দফা বা ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষ এক দফার সংগ্রাম শুরু করল। আর এই এক দফা হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ, ২ মার্চ, ১৯৭১) ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটি বিবৃতি দেন। পরদিন তা পাকিস্তানের সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘সারা বাংলাদেশে বাঙালীরা স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর সামনে প্রমাণ করেছে যে, তারা আর নির্যাতিত শোষিত হতে রাজি নয়; বাঙালীরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বিকেল ৩টায়। ওইদিনই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাত ৮টায় তৎকালীন ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগের তৎকালীন এবং প্রাক্তন ৮ নেতা এক জরুরী সভায় মিলিত হন। সভায় উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শাজাহান সিরাজ। এ সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক বিরাট ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রস্তাব পাঠ করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন দফতর সম্পাদক এম এ রশীদ। সভা মঞ্চে ছাত্রলীগের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং শাজাহান সিরাজ সম্মিলিতভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকাটি উড়িয়ে দেন। ১ মার্চ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন যে, ৭ মার্চ তিনি বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত কর্মসূচী ঘোষণা করবেন। এরপর থেকেই আশঙ্কা করা হয়েছিল যে কোন সময় বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার গ্রেফতার করতে পারে। সম্ভবত সেইজন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা না করে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক লীগের যৌথ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। তিনি প্রথমেই বলেন, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ ভাষণ। .... আমি যদি নাও থাকি, আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালীর স্বাধীনতার আন্দোলন যাতে না থামে। .... আমি মরে গেলেও সাত কোটি মানুষ দেখবে দেশ সত্যিকারের স্বাধীন হয়েছে।’ খবরটি ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়। এই সভায় প্রদত্ত ঘোষণা ইশতেহার আকারে প্রকাশ করা হয়। এই ইশতেহারে বলা হয়- ‘১. স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে, চুয়ান্ন হাজার পাঁচ শ’ ছয় বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। ক. পৃথিবীর বুকে বাঙালীর সাহিত্য-সংস্কৃতি পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা। খ. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে কৃষকরাজ-শ্রমিকরাজ কায়েম করা। গ. বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম। ২. বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে- ক. প্রতিটি অঞ্চলে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন। খ. জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা। গ. মুক্তিবাহিনী গঠন। ঘ. সাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিহার। ঙ. লুটতরাজ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধকরণ। ৩. স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা হবে নিম্নরূপ- ক. বর্তমান সরকারকে বিদেশী সরকার গণ্য করে এর সকল আইনকে বেআইনী বিবেচনা। খ. অবাঙালী সেনাবাহিনীকে শত্রুসৈন্য হিসেবে গণ্য এবং এদের খতম করা। গ. এদের সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা দেয়া বন্ধ। ঘ. আক্রমণরত শক্তিকে প্রতিরোধ করতে সশস্ত্র প্রস্তুতি গ্রহণ। ঙ. বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী দৃষ্টি নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলা। চ. স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ ব্যবহৃত হবে। ছ. পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য বর্জন ও সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলা। (জ) পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা ব্যবহার। ঝ. স্বাধীনতা সংগ্রামরত বীরদের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান। ৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬৬-৬৭) উল্লিখিত এই ঘোষণা ছাড়াও সভামঞ্চ থেকে আলাদাভাবে একটি প্রস্তাব পাঠ করা হয়। তাতে বলা হয়, ‘স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি সমাবেশ পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ- দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬৬ এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এবং তাঁর নির্দেশে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের যে রণনীতি ও রণকৌশল সভামঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়। সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা। সমাবেশের ঘোষণা ও প্রস্তাবে এই প্রথম লাখো জনতার সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়- ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্থাপনের ঘোষণা করা হয়েছে। এর ভৌগোলিক বিস্তৃতি চুয়ান্ন হাজার পাঁচ শ’ ছয় বর্গমাইল এবং সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করা হয় ‘বাংলাদেশ’। ওইদিনই সর্বপ্রথম বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠনের আদেশ দেয়া হয় এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতির জনক এবং সর্বাধিনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মূলত এভাবেই বাঙালীদের সুদীর্ঘ মুক্তি আন্দোলনের ধারায় ৩ মার্চ ১৯৭১ জাতির অন্যতম স্বপ্ন প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তবতা লাভ করে। ৩ মার্চ সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার পরও পাকিস্তানী সামরিকচক্র বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেনি। এর অন্যতম কারণ ছিল বাঙালীদের প্রতিরোধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব। তাদের সার্বিক প্রস্তুতি নিতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত লেগে গিয়েছিল। যে কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রবিবার দ্বিতীয়বার বাঙালীদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা ও সংগ্রামের সুস্পষ্ট কর্মসূচী নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ পান। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার বীজ তথা অগ্নিমন্ত্র। যুদ্ধের নয়টি মাস মুক্তিকামী বাঙালী জাতি তাদের প্রিয় নেতার ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনে উজ্জীবিত ও প্রাণিত হয়েছে। ৩ মার্চ আজকের এইদিনেই বাঙালীর ভবিষ্যত নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×