ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ০০:১০, ৫ জুন ২০২৫

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

আজ ৮ জিলহজ। হাদিসগ্রন্থ ও ইতিহাসে আছে, নবী ইব্রাহিম (আ.) যখন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার পবিত্র ঘরের আবাদের জন্য স্ত্রী-পুত্রকে রেখে ফিরে আসেন, তখন ইসমাইলের মা ইসমাইলকে নিজের বুকের দুধ পান করাতেন আর নিজে একটা মশক থেকে পানি পান করতেন। ওই পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গে শিশুপুত্রের জন্য তাঁর দুধে জোয়ার আসত। শেষ পর্যন্ত মশকের পানিও শেষ হয়ে গেল।  
তখন তিনি নিজেও পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লেন এবং বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ায় তাঁর শিশুপুত্রটিও পিপাসায় ছটফট করতে থাকে। তিনি দেখতে লাগলেন যে, পিপাসায় শিশুর বুক ধড়ফড় করছে। শিশুপুত্রের এই করুণ অবস্থার দিকে তাকানো তাঁর অসহ্য হয়ে উঠল। তিনি সরে পড়লেন এবং সাফা পাহাড়কেই একমাত্র নিকটতম পাহাড় হিসেবে পেলেন। তারপর তিনি এর ওপর উঠলেন এবং ময়দানের দিকে মুখ করলেন। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলেন, কাউকে দেখা যায় কি না। কিন্তু না, তিনি কাউকে দেখলেন না। তখন তাড়াতাড়ি সাফা পাহাড় থেকে নেমে পড়লেন।

যখন তিনি নিচে ময়দানে নামলেন, তখন নিজের জামা একদিক তুলে একজন ক্লান্ত ব্যক্তির মতো দৌড়ে চললেন। তারপর উপত্যকা অতিক্রম করে মারওয়া পাহাড়ে আসলেন এবং উপরে উঠলেন। চারদিকে নজর করলেন, কাউকে দেখা যায় কি না। লোকের খোঁজে তিনি পাহাড় দুটির মধ্যে এভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। এ জন্যই হজের সময় মানুষ এই পাহাড় দুটির মধ্যে সাতবার সায়ী করে বা জোরে হাঁটে।
তারপর তিনি যখন শেষবার মারওয়া পাহাড়ের উপর উঠলেন, তখন একটি আওয়াজ শুনলেন। তখন নিজে নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর, মনোযোগ দিয়ে শুনি। তিনি মনোযোগের সঙ্গে ওই আওয়াজ শুনলেন। তখন বললেন, তোমার আওয়াজ তো শুনিয়েছ। যদি তোমার কাছে কোনো সাহায্যকারী থাকে, তা হলে আমাকে সাহায্য কর। হঠাৎ তিনি যমযমের জায়গায় একজন ফেরেশতাকে দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে আঘাতের স্থান থেকে পানি উপচে উঠতে লাগল। হজরত হাজার এটির চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে তাকে কূপের আকার দান করলেন এবং অঞ্জলি ভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। এই হলো যমযম। বিখ্যাত যমযম কূপের ঐতিহাসিক সূচনা।
আর এর সুমিষ্ট ও সুস্বাস্থ্যকর পানির টানে ভিড়তে থাকে অসংখ্য আরব পরিবার। ক্রমেই গড়ে ওঠে মক্কা বসতি। পানির বিনিময়ে হাজার ও ইসমাইল অন্যদের কাছ থেকে অন্যান্য জীবিকা পেয়ে স্বনির্ভর হলেন। এরপর ইব্রাহিম স্ত্রীÑপুত্রকে দেখার জন্য মক্কায় আসেন কয়েকবার। 
আল্লাহর ইচ্ছায়, আবারও ইব্রাহিম (আ.) কিছুদিন তাদের কাছ থেকে দূরে রইলেন, পরে তাঁদের কাছে আসলেন। দেখলেন, ইসমাইল (আ.) যমযমের কাছে একটি গাছের নিচে বসে নিজের তীর মেরামত করছেন। বাপকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর পিতা পুত্রের সঙ্গে এবং পুত্র পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে যা করে, তাঁরা তাই করলেন। তারপর ইব্রাহিম (আ.) বললেন, হে ইসমাইল, আল্লাহ আমাকে একটি কাজের হুকুম করেছেন। ইসমাইল (আ.) জবাব দিলেন, আপনার প্রভু আপনাকে যা আদেশ করেছেন, আপনি তা করুন।

ইব্রাহিম (আ.) বললেন, এতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি? ইসমাইল (আ.) বললেন, হ্যাঁ, আমি নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করব। ইব্রাহিম (আ.) বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে, এর চারপাশে ঘেরাও করে একটি ঘর তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ বলে তিনি উঁচু পাহাড়টির দিকে ইশারা করে তাঁকে স্থানটি দেখালেন। তারপর তাঁরা কাবাঘরের দেওয়াল ওঠাতে শুরু করলেন। ইসমাইল (আ.) পাথর জোগান দিতেন এবং ইব্রাহিম (আ) গাঁথুনি করতেন। যখন নির্মাণকাজ শেষ হল, তাঁরা উভয়ে এই দোয়া করতে লাগলেন, ‘রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলীম...।’ (হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের কাছ থেকে এটি কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি বেশি শোনেন ও জানেন।)
আজ সে কবুল হওয়া মকবুল হওয়া ঘরের আলোকচ্ছটায় বিশ্ব উদ্ভাসিত। প্রতি বছর হজ ও ওমরাহর সময় লাখো কোটি মজনু হাজির লাব্বায়েক ধ্বনিতে এ এলাকা হয় প্রকম্পিত। আর বিশ্বের সর্বত্র সেই মহান পিতা-পুত্রের পুণ্যস্মৃতির ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদী তরিকায় উদ্যাপিত হয় পবিত্র ঈদুল আজহা বা পশু কোরবানির উৎসব। বছরের এ হজ ও কোরবানি উৎসবের মাধ্যমে উম্মাহর ধমনীতে নতুন করে সঞ্চারিত হয় দীনদারি, খোদাপ্রেম, তাকওয়া, প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (স.) ও তার পুণ্যাত্মা পরিবার পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালোবাসা, সর্বোপরি একতা, ভ্রাতৃত্ব, সত্য ও ন্যায়ের জন্য অকপটে জানমাল কোরবানির মহিমাময় শিক্ষা।

×