ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ভোগ বাড়াতে পারে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক

​​​​​​​খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ০০:০৪, ৩০ মার্চ ২০২৪

দুর্ভোগ বাড়াতে পারে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক

.

আসন্ন ঈদুল ফিতরের সময় বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের কারণ হতে পারে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক। ঈদে ঘরমুখো এবং  ঈদ পরবর্তী কর্মস্থলমুখো মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কায় এলাকাবাসী।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা প্রায় চারগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু ঢাকা থেকে ছয় লেনের বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পদ্মা সেতু পার হয়ে ৬৫ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গায় পৌঁছানোর পর বরিশাল পর্যন্ত ২৪ ফুট প্রশস্ত ৯১ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে তীব্র যানজট দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা।

১৯৬০ থেকে৬৬ সালের মধ্যে মাত্র পাঁচ টন বহনক্ষম মহাসড়কটি দুই যুগ আগে জাতীয় মহাসড়কের মর্যাদা লাভ করলে ১২ ফুট থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত করা হয়। কিন্তু এরপর বহন ক্ষমতা আর বাড়েনি। উপরন্তু দুই পাশের নানা অবৈধ স্থাপনা মহাসড়কটিকে গলা টিপে ধরেছে। পাশাপাশি বাড়তি ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে মহাসড়কের অবৈধ যানবাহনের আধিক্য। এতে করে বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্ঘটনার সংখ্যা।

সড়ক অধিদপ্তর হাইওয়ে পুলিশের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কে এখন প্রতিদিন গড়ে ১৮ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। যা ছয় লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় সমান। অবস্থায় বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি সিঙ্গেল

লেনের হওয়ায় প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি করে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত ২০ মার্চ পূর্ববর্তী ছয় মাসে মহাসড়কে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। ছাড়া নিত্যদিনের যানজটে প্রতিদিন নাকাল হচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রী।

সূত্রমতে, ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কের রাজৈর, টেকেরহাট, ভাঙ্গা, তালমামোড়, গৌরনদী, বাটাজোর, ভুরঘাটা, বরিশাল মহানগরীর নথুল্লাবাদ, নবগ্রাম রোড, চৌমহনী, আমতলা মোড়, রূপাতলী বাকেরগঞ্জে যানজট এখন নিয়মিত ঘটনা। যে কারণে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই এখন বিভিন্ন যানবাহনের প্রায় তিনঘণ্টা সময় চলে যাচ্ছে। ফলে সেতু চালুর পরে দ্রুত সময়ে ঢাকা সন্নিহিত এলাকায় পৌঁছানোর যে আশা করা হয়েছিল, তা মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে।

বরিশালের গৌরনদী হাইওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে মাদারীপুর সীমানার ভুরঘাটা পর্যন্ত মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩২ কিলোমিটারেই ২৭টি ব্ল্যাক স্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন। দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানগুলো হলো-ভুরঘাটা, ইল্লা, বার্থী, তারাকুপি, কটকস্থল, সাউদের খালপাড়, নীলখোলা, টরকী, গয়নাঘাটা, গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড, আশোকাঠী, কাসেমাবাদ, বেজহার, মাহিলাড়া, বাটাজোর, বামরাইল, সানুহার, জয়শ্রী, সোনার বাংলা, ইচলাদী, শিকারপুর-দোয়ারিকা টোল প্লাজা, মেজর এমএ জলিল সেতুর ঢাল, নতুনহাট, রহমতপুর ব্রিজের ঢাল, রেইনট্রিতলা কাশিপুর ব্র্যাক অফিসের মোড়। এসব স্পটগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ, অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাধারণ ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে কিছু জায়গায় সতর্কতামূলক চিহ্ন বসানো হচ্ছে।

সড়ক অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে ২০১৫ সাল থেকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি কুয়াকাটা পর্যন্ত ছয়লেনে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করে। যা ২০১৮ সালে শেষ হয়। এমনকি সমীক্ষার পথনকশা অনুযায়ী প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণে ১৮শকোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি আলাদা প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের তিনবছর পরেও ভূমি অধিগ্রহণ কাজের অর্ধেকও সম্পন্ন হয়নি। তবে ওইসব জমির বর্তমান বাজার মূল্য দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি, নতুন পথনকশা অনুযায়ী বাড়তি প্রায় দুইশহেক্টরসহ জমির মূল্য পরিশোধে দ্বিগুণেরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্রগুলোর দাবি, ইতোমধ্যে বরিশাল মহানগরীর পরিবর্তে প্রায় ১৬ কিলোমিটার বাইপাস নির্মাণের প্রয়োজন হওয়ায় সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। পটুয়াখালীতেও পথনকশার কিছু পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ফলে দুটি স্থানে আরও অন্তত দুইশহেক্টর বাড়তি ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। এজন্য ইতোমধ্যে সংশোধিতউন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপিতৈরির কথাও জানিয়েছে সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো।

অপরদিকে মহাড়কটির বরিশাল বিমানবন্দর ফরিদপুরে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলের কাছে এলাইনমেন্ট নিয়েও কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দুটি স্থানের এলাইনমেন্ট নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হতে পারে বলেও সূত্রটির ধারণা। সূত্রের দাবি, অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলে এডিবি ছাড়া আরও কয়েকটি দাতা সংস্থার সঙ্গে প্রকল্পটির অর্থায়ন নিয়ে কথা চলছে। অপরদিকে ২০১৫ সাল থেকে১৮ সালের মধ্যে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পথনকশা অনুযায়ী ২১১ কিলোমিটার মহাসড়কটির জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ২১ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও ভূমি অধিগ্রহণেই অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হতে পারে। যার পুরোটাই দিতে হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।

উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু অতিক্রম করে ভাঙ্গা পর্যন্ত ছয়লেনের এক্সপ্রেসওয়ে পৌঁছলেও সেখান থেকে ৯১ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল, ৩০ কিলোমিটার উত্তরে ফরিদপুর শহর এবং ১৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে পায়রা সমুদ্র বন্দর ২০৩ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পৌঁছানোর মহাসড়কের কোনোটিই মানসম্মত নয়। এসব মহাসড়ক এখনো মাত্র ১৮ থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত। ফলে  আসন্ন  ঈদুল ফিতরের আগে পরে দেশের নম্বর বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কে সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদুল ফিতরের আগে পরে মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনগুলো বেপরোয়াগতিতে না চালানো এবং ওভারটেকিং করতে না পারলে সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটবে। তবে হাইওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সড়ক জনপথ অধিদপ্তরের বরিশাল অফিসের কর্মকর্তাদের এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা যাত্রীরা যেন নিরাপদে ফিরতে পারেন, এজন্য বরিশালে পুলিশ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে ভুরঘাটা থেকে বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার মহাসড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনাপ্রবণ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং যানজটের সৃষ্টি হতে পারে এমন সব এলাকায় ট্রাফিক পরিদর্শকদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ঈদে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

×