শাহীন রহমান ॥ প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করে আইন করা হয় ২০০৫ সালে। ১৫ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে এই আইনের বাস্তবায়ন হয়েছে খুব কমই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধূমপান নিষিদ্ধ আইনটি দেশের জন্য যুগান্তকারী। মূলত সচেতনতা গড়ে তোলা এবং প্রচারের অভাবেই তা কার্যকর করা যায়নি। ফলে এখন সর্বত্র প্রকাশ্যেই এবং নির্বিঘ্নভাবেই চলছে ধূমপান। এর বিরুদ্ধে আইনটি কাজীর গরু কেতাবে থাকার মতোই প্রয়োগ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ১৫ বছরে আগের আইনটি কার্যকর না থাকায় নতুন প্রজন্মের অনেকে জানেই না এর বিরুদ্ধে দেশে আইন রয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে ইচ্ছামতো এবং প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেড়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং পরিবেশবিদ প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, একজন ধূমপায়ীর কারণে অন্যজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। এটা মানুষের নাগরিক অধিকার। কিন্তু আইনে থাকলেও কোথাও এই অধিকারের প্রয়োগ নেই। প্রকাশ্যে ধূমপানের কারণে শুধু পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলার বিষয়টি আমলে নিয়েই আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু শুধু আইন করেই ক্ষ্যান্ত দেয়া হয়েছে। ফলে প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। তিনি বলেন, সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যদি এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো, সাধারণ জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করা হতো তাহলে প্রকাশ্য ধূমপান অনেক কমে আসত।
সরেজমিন দেখা গেছে প্রায় সব উন্মুক্ত জায়গায় প্রকাশ্যে ধূমপান হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা যানবাহন কোন ক্ষেত্রে থেমে নেই। যানবাহনে যাত্রীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কম থাকলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালক ধূমপান করে থাকে প্রকাশ্যে। এছাড়া বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ, স্টিমারে ধূমপান চলে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে। তবে আইনে নিধিদ্ধ থাকার কারণে ধূমপানে উৎসাহিত করে এমন বিজ্ঞপন প্রচার নিষিদ্ধ থাকায় তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প কায়দায় এর প্রচার চালায়। বিশেষ করে ফুটপাথ এবং রাস্তার মোড়ে টি স্টলগুলোতে নানা ধরনের সিগারেটের বিজ্ঞাপন সেঁটে দেয়া সম্প্রতি অনেক বেড়েছে।
তামাক সেবন মানুষকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। এ বিষয়ে বর্তমানে কারও কোন দ্বিমত নেই। সম্প্রতি বিশ্বের করোনা মহামারী চলছে। বিশ্বব্যাংক থেকে এ বিষয়ে যে গবেষণা এবং গাইডলাইন প্রচার করা হচ্ছে সেখানে উল্লেখ করা হচ্ছে যারা নিয়মিত ধূমপান করে করোনাভাইরাস তাদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বে করোনায় যত মানুষ মারা গেছে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়মিত ধূমপানে আসক্তি ছিল বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে তামাকের কারণে বিভিন্নরকম ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, এজমাসহ নানা মৃত্যুঘাতী রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যে পরিবার এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সে পরিবার নানা সঙ্কটের মধ্যে পড়ছে। এসব রোগে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেও সরকারের স্বাস্থ্য খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, এই যে স্বাস্থ্যখাতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকায় ব্যয় করছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে সরকার একটাকাও ব্যয় করছে না। সরকার যদি এই আইন কার্যকরের আগে ছয়মাস প্রচার চালাত এবং জনগণকে ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতন করত তাহলে প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতা অনেক কমে আসত। উঠতি বয়স থেকে শুরু করে কেউ প্রকাশ্যে ধূমপান করতে সাহস পেত না। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধ করতে হলে এখনই আইনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন প্রয়োগের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের এ বিষয়ে আরও দায়িত্ববান হতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রতিবছর লাখের ওপর মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। যারা নিয়মিত তামাক সেবন করছে তাদের প্রতি দুইজনের একজন তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, বিশ্বে প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন ধরে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি লোক তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। প্রতিবছর বিশ্বের ৬০ লাখের বেশি লোক তামাক সেবনের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। বাংলাদেশে তামাক সেবনের হার অনেক বেশি। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৪৩.৩ ভাগ লোক বিভিন্নরকম তামাক ব্যবহার করে থাকে। সংখ্যায় তামাক ব্যবহারের হার প্রায় সোয়া চার কোটি। তামাক সেবন জনিত মৃত্যুর সংখ্যাও দেশে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বছর তামাক সেবনের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে লাখের অধিক লোক মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে গবেষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ডায়াবেটিস সম্প্রতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের প্রায় ৯৮.৭ ভাগ মানুষের মধ্যে অন্তত একটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। ৭৭.৪ ভাগ মানুষের মধ্যের অন্তত দুটি অসংক্রামক রোগে ঝুঁকি রয়েছে। ২৮.৩ ভাগের মধ্যে অন্তত তিনটি অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি রয়েছে। এ গবেষণায় দেখা গেছে হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে যথাক্রমে ১৭.৯ ভাগ এবং ৩.৯ ভাগ। যা তামাক সেবনের কারণে মূলত হয়ে থাকে।