ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পাউবোর বরাদ্দ খুবই কম ॥ কৃষক হতাশ

আবারও বন্যা ঝুঁকিতে হাওড় এলাকা-স্থায়ী বাঁধ এখনও অধরা

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭

আবারও বন্যা ঝুঁকিতে হাওড় এলাকা-স্থায়ী বাঁধ এখনও অধরা

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে ॥ হাওড়ের কৃষকদের ফসল রক্ষায় স্থায়ী ও উঁচু বাঁধ নির্মাণের স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে? আবারও কি আগাম বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে অসংখ্য বেড়িবাঁধ? পাউবোর নগন্য(!) বরাদ্দের কারণে ফের এমনই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, এত হই-চইয়ের পরও নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ সংস্কারের জন্য চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ অর্থও বরাদ্দ দেয়নি পাউব। শীঘ্র বরাদ্দ বৃদ্ধি না করলে আগামী বোরো মৌসুমে অনেক বাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। আর এতে উপেক্ষিত হবে হাওড়বাসীকে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি। অরণ্যে রোদন(!) হয়ে থাকবে হাজার হাজার কৃষকের প্রাণের দাবি। পাউবোর স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ, মদন ও কলমাকান্দা উপজেলার হাওড়াঞ্চলে ২৭১ কিলোমিটার ডুবন্ত (অস্থায়ী) বাঁধ রয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির রোরো ফসলের জন্য স্থানীয় কৃষকরা এসব বাঁধের ওপর নির্ভর করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতবারের বন্যার ধকল, দুর্নীতি এবং যথাযথভাবে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব বাঁধের সিংহভাগ এলাকা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। অস্থায়ী, ডুবন্ত এবং চরম ঝুঁকিপূর্ণ এসব ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামতের জন্য পাউবোর নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে ১২টি প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য (এরমধ্যে ৮টি প্রকল্প হাওড় এলাকায়) চলতি অর্থবছরে ১৯ কোটি ২৩ লাখ টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয় থেকে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৩ কোটি ১০ লাখ টাকাÑ যা চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগও নয়। চাহিদার তুলনায় এ নগন্য বরাদ্দ হাওড়ের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রীতিমতো হতাশ করেছে। সূত্র জানায়, হাওড়দ্বীপ খালিয়াজুরি উপজেলার পাঁচটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন প্রকল্পের (কীর্তনখোলা, চৌতারা, জগন্নাথপুর ঢালা, কৃষ্ণপুর, নাওটানা খালসহ আরও কয়েকটি বাঁধ) জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয় ১০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। কিন্তু এই চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ২ কোটি ৮১ হাজার টাকা। একইভাবে মোহনগঞ্জের সবচেয়ে বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ হাইজদা (ধনু নদী তীরবর্তী) বাঁধের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয় ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অথচ বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৬০ লাখ টাকা। মদন উপজেলার বালালী পদমশ্রী ও তিয়শ্রী হাওড় উপপ্রকল্পের জন্য ৬৬ লাখ টাকার চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কলমাকান্দা ও ধর্মপাশা উপজেলার উব্দাখালি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয় ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। কিন্তু বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বারহাট্টা উপজেলার সিংগাইর বিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের জন্য পাউবোর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ চায় ৩৭ লাখ টাকা। অথচ বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৭ লাখ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, অপ্রতুল এ বরাদ্দ দিয়ে অনেক বাঁধই আশানুরূপ মেরামত করা যাবে না। ফলে আগাম বন্যায় ফসলহানির ঝুঁকি থেকেই যাবে। জানা গেছে, চলতি বছরের (২০১৭) মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অতি বৃষ্টি, পাহাড়ী ঢল ও আগাম বন্যা নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের সিংহভাগ বোরো ফসল কেড়ে নেয়। একমাত্র ফসল ও তার সঙ্গে সম্পূর্ণ পুঁজি হারিয়ে হাজার হাজার কৃষক পরিবার রীতিমতো নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে যায়। অপ্রতুল বরাদ্দ, শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে বাঁধ মেরামত, ঠিকাদার ও পিআইসি কমিটির দুর্নীতিসহ নানা কারণে একটি হাওড় রক্ষা বাঁধও কৃষকের ফসল রক্ষা করতে পারেনি। হাওড়ের কৃষকদের এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে তখন সরকারের নীতি নির্ধারকদের টনক নড়ে। কিন্তু পাউবোর এই অপ্রতুল বরাদ্দ স্থানীয় কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের রীতিমতো হতাশ করেছে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গেল বারের হৈ-চৈইয়ের পর বাঁধ মেরামতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে ‘কাবিটা’ নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। খালিয়াজুরি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার (শোয়ের সিদ্দিকী) বলেন, বাঁধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেÑ তা অতি নগন্য। এই টাকায় হাওড়ের সমস্ত বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হবে না। অনেক বাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থেকে যাবেÑ যা ফের আগাম বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি আরও বলেন, পরপর দুবার হাওড় এলাকার মানুষ ফসল মার খেয়েছে। অনেক কৃষক পরিবার সরকারী সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে প্রাণে বেঁচে আছে। আবার যদি এ এলাকায় আগাম বন্যা হয়Ñ তাহলে এ অঞ্চলের মনুষের আর বাঁচার কোন অবলম্বন থাকবে না। হাওড়ের বাঁধ সংস্কারে অপ্রতুল বরাদ্দের কথা স্বীকার করে জেলা প্রশাসক ড. মোঃ মুশফিকুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাবিটার জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য পাউবোর মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি পাঠিয়েছি। তবে এখনও চিঠির কোন জবাব পাইনি। পাউবোর নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু তাহের বলেন, নতুন নীতিমালায় আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাবিটা প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। প্রাপ্ত অর্থের ভিত্তিতে আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এছাড়া অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে চেয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। আশা করছি কর্তৃপক্ষ চাহিদার বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
×