সংসদ রিপোর্টার ॥ বিশ্ব জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের ফলে সারাবিশ্বে ঝুঁকি বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বণ নিঃসরণের ফলে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এতে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ফলে সারাবিশ্বে ঝুঁকি বাড়ছে। অনেকেরই জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সাগর উপকূলে থাকা দেশগুলো এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। যে কোন মুহূর্তে ওই দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) সদস্য দেশগুলোর সংসদ সদস্যরা এ ঝুঁকি মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
সিপিএ’র ৬৩তম সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবার সম্মেলনস্থল হোটেল রেসিন ব্লুতে অনুষ্ঠিত কর্মসূচীতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। একাধিক সংসদ সদস্য জানান, বৃহস্পতিবার সিপিএ স্মল ব্রাঞ্চের কনফারেন্সে আলোচনার প্রধান ইস্যু ছিল জলবায়ু পরিবর্তন। ছোট ছোট ৪৩টি দ্বীপরাষ্ট্রের সংসদকে নিয়ে সিপিএর এ ব্রাঞ্চ। সকালে এ ব্রাঞ্চের ৩৬তম কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে ভিডিওচিত্র ও কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরা হয়। কবিরুল ইসলাম রতনের পরিচালনায় একঝাঁক তরুণ-তরুণী ভিডিওচিত্রের সঙ্গে নৃত্যের মাধ্যমে দ্বীপ-সাগর ও প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের এ ঝুঁকি মোকাবেলা করে সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নের চিত্রটি উঠে আসে।
অনুষ্ঠানে সিপিএ চেয়ারপার্সন ও জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর উদ্বোধনী বক্তৃতাতেও ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সংসদ সদস্যদের বিশেষ ভূমিকা রাখার আহ্বান। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন জীবনযাত্রাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। সাগর উপকূলের দেশ নয়, সারাবিশ্বেই ঝুঁকি বাড়ছে। আর বাংলাদেশ তো জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির হুমকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ঝুঁকি মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ওই চুক্তির আলোকে জলবায়ুর অভিঘাত ও ক্ষতি মোকাবেলায় ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, তরুণ প্রজন্মকেও রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে ও সংসদীয় রীতিনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সিপিএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন সিপিএ স্মল ব্রাঞ্চ চেয়ারপার্সন ও মাল্টার স্পীকার এ্যাঞ্জেলো ফারুগিয়া। বক্তৃতা করেন সিপিএ সেক্রেটারি জেনারেল আকবর খান। তিনি বলেন, সংসদে নারী-পুরুষের সমতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতে আমরা বদ্ধপরিকর। ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য বিশ্বের তরুণসমাজকে দক্ষ করে তোলার জন্যও সিপিএ কাজ করছে। এক্ষেত্রে ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রে বিশেষ উদ্যোগও রয়েছে। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলার পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সিপিএ নানামুখী কর্মসূচী অব্যাহত রাখবে। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভৌগোলিকভাবে জীবনযাত্রাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। জলবায়ুর অভিঘাত ও ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেসব বিষয়ে কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শিরীন শারমিনের
উত্তরসূরিও নারী
সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোর অন্যতম বৃহৎ সংস্থা সিপিএ’র পরবর্তী নেতৃত্বেও আসছেন নারী। নির্ভরযোগ্য সূত্রে যানা গেছে, এবারের সম্মেলনে নতুন চেয়ারপার্সন নির্বাচন করা হবে। সিপিএ নির্বাচনে নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন পদে প্রতিদ্বন্দ্বী তিনজনই হচ্ছেন নারী প্রার্থী। আগামী ৭ নবেম্বর ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে বিজয়ী বর্তমান চেয়ারপার্সন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর উত্তরসূরি হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। এ বিষয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করেননি ¯ীúকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে আভাস দেন, প্রার্থীদের তিনজনই নারী, যাদের একজন ক্যারিবীয়, একজন আফ্রিকান ও একজন প্যাসিফিক অঞ্চলের। ফলে পরবর্তী নেতৃত্বে নারী আসছেন এটা নিশ্চিত। উল্লেখ্য, সম্প্রতি রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সংসদীয় গণতন্ত্রের বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংস্থা ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নেও (আইপিইউ) প্রেসিডেন্ট পদে একজন নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হচ্ছেন মেক্সিকোর গ্যাব্রিয়েল ব্যারন। তিনি আইপিইউর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর উত্তরসূরি।
সংসদে ৩০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব বড় চ্যালেঞ্জ
কমনওয়েথভুক্ত সদস্য দেশগুলোর সংসদে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ অর্জন করার প্রত্যাশা এখন একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন কমনওয়েলথ উইমেন পার্লামেন্টারিয়ানস (সিডব্লিউপি)। এ বিষয়ে সংস্থার চেয়ারপার্সন ও মালয়েশিয়ান সংসদ সদস্য ড. ডাটো নরাইনি আহমেদ বলেন, কমনওয়েলথভুক্ত ৫২টি দেশের ১৮০টি সংসদ রয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক সংসদে একজনও নারী প্রতিনিধি নেই। বর্তমানে ১৪৪টি সংসদে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
হোটেল রেডিসন ব্লুতে দিনব্যাপী সিডব্লিউপি স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান। এ সময় সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি ও ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে ড. ডাটো নরাইনি বলেন, সংসদে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সংসদে নারীর কাক্সিক্ষত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চাই। একই সঙ্গে কমনওয়েলথে প্রতিনিধিত্বকারী নারীদের সংখ্যার সমতা বিধানের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং আইন প্রণয়নের জন্য সংসদে নিয়ে আসতে চাই। কারণ গোটা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
কমিটির বৈঠকের আলোচনার সূত্র ধরে ডেটো বলেন, সর্বত্র নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছি, যার মধ্যে একটি শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলে তাদের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তৈরি করছি। কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে সম্মেলনে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হবে বলে তিনি জানান।
গণতন্ত্রের বিকাশে এমপিদের একসঙ্গে কাজ করার
আহ্বান স্পীকারের
সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা ও বিকাশে সারাবিশ্বের সংসদ সদস্যদের একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলতে ও সংসদীয় রীতিনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সিপিএ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এজন্য বিভিন্ন সময় তরুণদের নিয়ে রোডশো করা হয়। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিতে এলে আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
স্মল ব্রাঞ্চের কনফারেন্স থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসবে উল্লেথ করে তিনি বলেন, এ কনফারেন্সের মাধ্যমে ছোট ছোট দেশের একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্রাঞ্চের দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হবে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করা সম্ভব হবে, যা পরবর্তীতে যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে স্মল ব্রাঞ্চকে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন জীবনযাত্রাকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির হুমকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্যারিস চুক্তির আলোকে জলবায়ুর অভিঘাত ও ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, এ কনফারেন্সের মাধ্যমে স্মল ব্রাঞ্চের দেশগুলোর একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতা বিনিময় সম্ভব হবে, যা পরবর্তীতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
স্মল ব্রাঞ্চের স্পীকারের সংবাদ সম্মেলন
বৃহস্পতিবার সকালে সম্মেলনস্থলে এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিএ স্মল ব্রাঞ্চ চেয়ারপার্সন ও মাল্টার স্পীকার এ্যাঞ্জেলো ফারুগিয়া বলেন, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং উপযুক্ত দিকনির্দেশনার অভাবে তরুণরা রাজনীতিতে আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আমরা রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারছি না। স্মল ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে তরুণদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কারণ তারা রাজনীতিতে এলে আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে। স্মল ব্রাঞ্চের পক্ষ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন, রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে আনার বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, গত পহেলা নবেম্বর থেকে ঢাকায় শুরু হয়েছে সিপিএ’র ৬৩তম সম্মেলন। তবে এ সম্মেলনের মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হবে ৫ নবেম্বর। এরপর থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলনের মূল কার্যক্রম শুরু হবে। সম্মেলন শেষে হবে আগামী ৮ নবেম্বর। ৫ নবেম্বর মূল অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন সম্মেলনের ভাইস প্যাট্রন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।