ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লাখো মানুষের ভিড়ে নেই আমার স্বামী

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৩ অক্টোবর ২০১৭

লাখো মানুষের ভিড়ে নেই আমার স্বামী

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ আমি কোথায় এসেছি, বাড়িতে নাকি শরণার্থী জীবনে এটা সব সময় ভুলে যাই। মনে হয় হাশিমের বাবা বাজার থেকে ঘরে আসছে। তাড়াতাড়ি টুকটাক কাজ সেরে দরজায় দাঁড়াই। হাশিমকে কোলে নিয়ে একটু সম্মুখে গেলেই ধ্যান পাল্টে আমার। এসব কি? তখন দেখি লাখো মানুষ আর মানুষ। ওই লাখো মানুষের ভিড়ে হাশিমের বাবা নেই। নেই আমার আদরের স্বামী বড় মাপের ব্যবসায়ী জিয়াবুল। তারপর বুঝতে পারি আমি মিয়ানমারে নিজের হাতে সাজানো ঘরে নয়, পরবাসী হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত। রাখাইনে মগজাতি তছনছ করে দিয়েছে আমার সুখের সংসার। তারা কেড়ে নিয়েছে আমার সব কিছু। মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে টেকনাফের কেরুনতলী বস্তিতে আশ্রিত রোহিঙ্গা বিধবা নারী নুর ফাতিমা বুধবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলছিলেন এসব কথা। মিয়ানমার থেকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সাময়িক ভুলে থাকলেও কিছুটা স্থিতি শেষে ফের শোকে কাতর হয়ে পড়ছেন তিনি। নুর ফাতিমা বলেন, রাখাইনে ধর্ষিত বহু যুবতী-কিশোরী হারিয়েছে তাদের পিতাকে। গৃহবধূ স্বামীহারা বিধবা হয়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। মা-বাবা হারা এতিম বহু শিশু এবং সন্তানহারা মা-বাবা এসেছেন এখানে। এসব নারীর স্বামী এবং সন্তানের পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে মিয়ানমারে। নাডালা বাহিনীর সদস্যরাও সেনা বাহিনীর চেয়ে কম অত্যাচার করেনি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের। ওই বাহিনীর কাছেও অস্ত্র রয়েছে। সেনা সদস্যরা নির্যাতন করে চলে গেলে মনে হতো হয়ত মিলিটারি আবার আসতে কয়েকদিন লাগতে পারে। এরই মধ্যে আমরা দেশান্তর হব। কিন্তু না কিছুক্ষণ পরপর নাডালা বাহিনীর সদস্যরা এসে মারধর, ছিনতাই ও পাশবিক নির্যাতনসহ পুরুষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে চলে যায়। মংডু কেয়ারিপ্রাং এলাকার বাসিন্দা নুর ফাতিমা আরও জানান, তার স্বামী জিয়াবুল হক মংডু টাউনশীপে কাপড়ের ব্যবসা করত। লাখ লাখ টাকার মালভর্তি পাইকারি বড় দোকান ছিল। সঙ্গে করে যা নিয়ে আসতে পারব তা গুছিয়ে নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। ঠিক আছরের নামাজের আগে আগে সেনাবাহিনী এসে আমাদের পাড়া ঘেরাউ করে। হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেয় কেউ ঘর থেকে বের হলে ব্রাশফায়ার করে প্রাণে শেষ করে দেয়া হবে। আমরা ভয়ে চুপচাপ হয়ে পড়ি। কয়েক সেনা এসে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক আমার স্বামী ব্যবসায়ী জিয়াবুলকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সেনাবাহিনীর পায়ে পড়ে অনেক কাকুতি করেছি। তখন আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি পরিত্যক্ত পাঠশালায়। সেখানে দেখি আরও সেনা সদস্য আছে। এক কোনায় দেখা গেছে আমার মতো অন্তত ১০-১৫ যুবতী বসে বসে কাঁদছে। এসব দেখে বিচলিত হয়ে পড়ি। ভাগ্যিস- সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে-সেনারা আমার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেনি। সন্ধ্যার আগে বৃদ্ধ শাশুড়ি এসে আমাকে ঘরে নিয়ে যান। ঘরে গিয়ে শুনি আমার স্বামীকে হত্যা করে অপর রোহিঙ্গাদের লাশের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাড়িতে করে নিয়ে গেছে। আমার অবুঝ সন্তান বাবাকে চেনার আগেই এতিম হয়েছে। ওইদিন রাতে আমরা ঘর থেকে বের হয়ে পাশের পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান নিয়ে পাঁচদিন হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে পৌঁছি। এদিকে মিয়ানমারে সরকারী বাহিনীর অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে নুর ফাতিমার মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের চোখে এখনও ভাসছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের চিত্র। টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রিত শিবিরে রোহিঙ্গাদের কক্ষে বিধবা নারী, এতিম সন্তান, ধর্ষিতা যুবতী-কিশোরী, স্বামীহারা বিধবা, মা-বাবাহারা শিশু, সন্তানহারা মা-বাবা রয়েছে। ওসব কক্ষে এখনও প্রতিরাতে স্বজনহারা রোহিঙ্গাদের আহাজারিতে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত জনপদের বাতাস ক্রমে ভারি হয়ে উঠছে।
×