ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সঙ্কটে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংকও, সহায়তার আশ্বাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সঙ্কটে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংকও, সহায়তার আশ্বাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলেছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। সহিংসতার শিকার হয়ে তারা দেশ ছাড়ছে। চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জাতিসংঘের মতো বিশ্বব্যাংকও উদ্বিগ্ন। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতেও প্রস্তুত এ বহুজাতিক সংস্থা। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলেই এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। বুধবার ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংস্থাটির কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান এসব কথা বলেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে এ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে চিমিয়াও ফান বলেন, বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি আইডিএ-১৮ তে ‘রিফিউজি ফান্ড’ নামে নতুন একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এর পরিমাণ ২০০ কোটি ডলার। যে কোন দেশ প্রয়োজনে তিন বছরে সর্বোচ্চ ৪০ কোটি ডলার ঋণ পেতে পারে। বাংলাদেশও এই তহবিল পাওয়ার যোগ্য। বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাংকও এ সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে। অন্যান্য দাতা সংস্থার মতো, বিশ্বব্যাংকও পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান চিমিয়াও ফান। সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের তৈরি প্রতিবেদন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্থার অপারেশন ম্যানেজার রাজশ্রী পারালকার, যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহবুবসহ প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা। যা আছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ॥ চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। যদিও সরকার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। কিন্তু সেটি পূরণ না হলেও পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি হলে তা হবে চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের এ প্রবৃদ্ধি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক উভয়দিক মূল্যায়নেই ভাল অর্জন হবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। তবে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে যাবে এ অর্থবছরে। অন্যদিকে মানসম্মত কর্মসংস্থান তৈরি করাসহ দেশের অর্থনীতিতে ১১ চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে চালের দাম বৃদ্ধির তিন কারণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, বাংলাদেশের জন্য ভাল খবর হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং তা রয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভাল হচ্ছে। রিজার্ভ ভাল। তবে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণের সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকে তারল্য রয়েছে যা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে আসা প্রয়োজন। কার্যকর কর্মসংস্থান বাড়ানো দরকার। কেননা এটি দারিদ্র্য নিরসনের হাতিয়ার। তিনি বলেন, অর্থনীতির জন্য পলিসি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রফতানি বহুমুখীকরণের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। চলতি বছর ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ॥ প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় বাংলাদেশের ৬ শতাংশের ওপরে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রশংসা করে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রবৃদ্ধির এই প্রাক্কলন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি। ভারতে এবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন দেয়া হয়েছে, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থবছর শেষে সেটা অর্জন করা যাবে না। এছাড়া চলতি অর্থবছর চীনের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়ার ৫ দশমিক ৩, থাইল্যান্ডের ৩ দশমিক ৩, পাকিস্তানের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। বলা হয়েছে, বন্যার কারণে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমলেও শিল্প ও সেবা খাতে বাড়বে। যদিও সরকারী হিসাব বলছে, প্রায় এক দশক পর গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘর অতিক্রম করে। চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয় ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। ঘুরে দাঁড়াবে রেমিটেন্স খাত ॥ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জাহিদ হোসেন বলেন, রফতানি খাত এখন ভাল করছে। গত অর্থবছরে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এবার প্রথম দুই মাসের যে তথ্য পাওয়া গেছে তা ইতিবাচক। রফতানির পাশাপাশি রেমিটেন্স প্রবাহে গত অর্থবছর বড় ধাক্কা খেয়েছিল বাংলাদেশ। রেমিটেন্স কমেছিল ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এবার তা ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তিনি বলেন, জনশক্তি রফতানি এবার বেশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে বিদেশে শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ। গত ২ বছরে সেটি বেড়ে ২০১৭ সালে হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ। তবে ভারত, পাকিস্তান এবং নেপালেও প্রবাসী আয় কমেছে। শুধু শ্রীলঙ্কায় কিছুটা বেড়েছে। প্রবাসী আয় কমার কারণ হিসেবে শুধু তেলের দাম কমাকে দায়ী করা যায় না। এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন অভিবাসী নীতি চূড়ান্ত না হওয়া এবং আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে (ব্যাংক) রেমিটেন্স আসা কমে যাওয়াও দায়ী। মূল্যস্ফীতি বেড়ে হবে ৬ শতাংশ, চালের দাম বৃদ্ধির তিন কারণ ॥ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে সরকারী লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি ৬ শতাংশ হবে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। চালের দাম বৃদ্ধি একটি অন্যতম কারণ। তবে চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি সরলীকরণ করা হয়েছে বলে মনে করেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, চালের দাম বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে দুটো বন্যা। প্রথমে হাওড় অঞ্চলে এবং পরে দেশের অন্য অংশে বড় বন্যায় মোট ২০ লাখ টন শস্য উৎপাদন কমেছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, চালের শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ও বিলম্ব। শুল্ক কমানো হবে সেটি বলা হলেও সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় নেয়া হয়েছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে ভারত চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে বলে গুজব ছড়ানো। এসব কারণে দেশের বাজারে চালের দাম বেড়েছে। ফলে সেই সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা মজুদ গড়ে তুলতে পারে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চ্যালেঞ্জ মানসম্মত কর্মসংস্থান ॥ মানসস্মত অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিককালে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কমে গেছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কর্মসংস্থানে গতি ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ। সেটি ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কমে ২ শতাংশের নিচে নেমেছে। এর পেছনে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, আর্থিক খাতের সংস্কার না হওয়া ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম বাজারের আধিপত্যই বড় কারণ। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটিতে গতি নেই। তাছাড়া বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয় প্রয়োজন। কিন্তু জাতীয় সঞ্চয় কিছুটা কমেছে। প্রতিবেদনে চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়নে বেশ কিছু অপ্রত্যাশিত চাপ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। যেমনÑ বন্যার কারণে খাদ্যে অতিরিক্ত ভর্তুকি, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সংস্থান। এ ছাড়া নির্বাচনের আগের বছর হওয়ায় চলতি বছরে বড় ধরনের সংস্কারের সম্ভাবনা কম, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশর অর্থনীতির জন্য অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে, বিদ্যুত জ্বালানিসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিকল্পিত নগরায়ন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অবকাঠামোর পার্থক্য দূর করা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো, মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, শিল্প ও শ্রমনীতি সংস্কার করা, পোশাক শিল্পের বাইরে রফতানি বহুমুখীকরণ, কর্মসংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে উত্তরণ, প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ানো, নারীর নিরাপদ অভিবাসন ইত্যাদি।
×