মোরসালিন মিজান ॥ আগস্ট মানেই বিয়োগব্যথা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। সেই বেদনার ভয়াল ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বাঙালী। আর তারপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। প্রকাশ্য জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুপুরী বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ। সেই মৃত্যু সেই বিভীষিকার কথা স্থাপনাশিল্পের ভাষায় বলার চেষ্টা করেছেন মাহবুবুর রহমান। মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার ভয়াবহতা বর্ণনা করছে তার ইনস্টলেশন আর্ট। সংবেদনশীল শিল্পীমনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। রবিবার থেকে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় শুরু হওয়া প্রদর্শনী কাল দিবসটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শোকসাগরে ভাসায়।
ভাস্কর্য গ্যালারির প্রায় পুরোটা নিয়ে কাজ করেছেন মাহবুবুর রহমান। আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, লাইট, সাউন্ডসহ বেশ কিছু মাধ্যম ব্যবহার করে নিজস্ব শিল্পভাষা গড়েছেন তিনি। প্রধান দেয়ালে তিনটি সাইডস্ক্রিন। সব ক’টিতে ২১ আগস্টের রোদেলা বিকেল। প্রতিবাদী সমাবেশ চলছে। ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ। সেখানে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগনেত্রী বক্তৃতা করছেন। মুখে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ মানুষের কথা। কথা শেষ করতে পারেন না। বলেন, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে...। ঠিক তখনই বিকট আওয়াজ। অন্ধকার গিলে খেতে চায়। রোদেলা বিকেল পরাজিত। প্রজেক্টরের আলো দেয়ালে পড়লেও, কিছু দৃশ্যমান হয় না। আকস্মিক কেবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে টেলিভিশনের স্ক্রিনটি যেমন দেখায়, ঠিক তা-ই দেখানোর চেষ্টা করেন শিল্পী। মূলত বলাÑ সব থেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও যে প্রাণের স্পন্দন ছিল, আর নেই। অন্ধকার গ্যালারিটিও দ্রুত বদলে যেতে থাকে। ধোঁয়া আচ্ছাদিত হয়ে যায় চারপাশ। কিছু দেখা যায় না। কানে আসে বহু মানুষের আর্তচিৎকার। মাতম। কয়েক সেকেন্ড পরে যখন দৃশ্যমান হয় সব, কিছুই আগের মতো নেই। কেবল মৃত্যু। রক্ত আর রক্তে ভেসে যাওয়া। ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছে মানুষ। কারও হাত নেই। কব্জি উড়ে গেছে। কেউ হারিয়েছেন পা। নারীদের ক্ষতবিক্ষত শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তার ঠিক পাশেই মানবতাবিরোধীদের ছোড়া গ্রেনেড। গ্রেনেডের স্পিøন্টারে বিদ্ধ কাতরাচ্ছে মানুষ। যে যার মতো ছুটছে। দৃশ্যগুলো সেøা মোশনে দেখান শিল্পী। থমকে যাওয়া সময়টি ধরতেই এ প্রয়াস। বেদনাকে গাঢ় করে নেপথ্যের করুণ সুর। একজন স্বজনের কণ্ঠে ভেসে আসে। বর্ণনা থেকে জানা যায়, চোখের সামনে তার বাবার মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে তিনি দূরে ছিটকে পড়া পায়ের একটি অংশ দেখিয়ে বলেছিলেন, ওই যে আমার পা। মেয়ে জানান, ওটাই ছিল তার শেষ কথা!
ভিজ্যুয়ালাইজেশনের সঙ্গে মিল রেখে সাজানো হয়েছে গ্যালারি। মেঝের একপাশে ৯টি মৃতদেহ। ভাস্কর্য বটে। হঠাৎ দেখে তা মনে হয় না। বরং আঁতকে ওঠে ভেতর। পাশেই মানুষের জামাকাপড়। ছেঁড়া স্যান্ডেল। ব্যবহার করা জিনিসপত্র। সবই স্তূপ করে রাখা। কাপড়-স্যান্ডেলের স্তূপে মানুষের ছিন্ন মস্তক! হ্যাঁ, ফিগার ব্যবহার করেছেন শিল্পী। তবে এত নিখুঁতভাবে যে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। অন্য দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে কিছু আলোকচিত্র। সেখানেও মৃত্যু। সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী একটি স্থাপনা শিল্প। কিছু সময় গ্যালারির ভেতর অবস্থান করলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নিজের অজান্তেই মন বলে ওঠে, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।
সকালে তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। যে অপশক্তি একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন করেছে, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করছে তারাই এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টকে বাঙালীর জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, যারা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে তারাই একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছে। সেদিন আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব গ্রেনেড তখন কেবলমাত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীই ব্যবহার করত। সুতরাং, বোঝাই যায় কারা সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যা করে বাংলাদেশের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে চেয়েছিল। পঁচাত্তরের পনেরাই আগস্ট, ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের ঘটনাসহ দেশব্যাপী মুক্তচিন্তার মানুষসহ ধর্মযাজক-পুরোহিত-ইমামদের হত্যার ঘটনা একইসূত্রে গাঁথা বলে মন্তব্য করেন তিনি। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, এসব ঘটনার বিশ্লেষণ করে আমাদের এখন কর্তব্য সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলে সাংস্কৃতিক ও মানবিকবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে কাজ করা। তবেই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন সত্যি হবে।
তিন দিনের প্রদর্শনী চলবে মঙ্গলবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে।