গাফফার খান চৌধুরী ॥ মিরপুরের জঙ্গী আস্তানায় তৈরি গ্রেনেড দিয়েই হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হামলা করা হয়েছিল। এমনকি চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর মসজিদে হামলায়ও এই কারখানার তৈরি গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত তদন্তকারীরা। এই কারখানার তৈরি গ্রেনেড দিয়েই খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন ও থার্টিফার্স্ট নাইটে নাশকতা চালানোর চক্রান্তও ছিল। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারিতে জঙ্গীদের সে আশায় গুড়েবালি পড়ে। তবে মিরপুরের কারখানায় তৈরি অনেক গ্রেনেড ধাপে ধাপে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জেএমবি জঙ্গীদের কাছে চলে গেছে। সেসব গ্রেনেড উদ্ধার এবং কারখানায় গ্রেনেড তৈরির দুই কারিগর পলাতক জেএমবির শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করতে অভিযান চলছে। পুরো চক্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে মিরপুরের কারখানা থেকে আটক ৩ জেএমবি জঙ্গীকে দ্বিতীয় দফায় ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
বিদায়ী বছরের ২৪ ডিসেম্বর ডিএমপির অভিযানে রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এ ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের ৩ নম্বর বাড়িতে জেএমবির গ্রেনেড তৈরির কারখানা আবিষ্কৃত হয়। কারখানায় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে উদ্ধার হয় শক্তিশালী ১৬ হ্যান্ডগ্রেনেড ও একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাইপ গ্রেনেড, সুইসাইডাল ভেস্ট (আত্মঘাতী হামলা চালানোর জন্য শরীরের সঙ্গে গ্রেনেড বেঁধে রাখার বিশেষ বেল্ট) ও ২শ’ হ্যান্ডগ্রেনেড তৈরির সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক। গ্রেফতার হয় জেএমবির প্রশিক্ষিত তিন সদস্যসহ ৭ জন। এদের মধ্যে জেএমবির ৩ সদস্যকে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
শুক্রবার ৬ দিনের রিমান্ড শেষে তিন জেএমবি সদস্যকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে ফের ৭ দিনের রিমান্ডের জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মুমিন খান।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, তিন আসামি জেএমবির সক্রিয় সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড পলাতক আসামি মুস্তাফিজুর রহমান ওরফে শাকিল এবং সোহেল রানা ওরফে হিরন ওরফে কামালকে গ্রেফতারের জন্য আসামিদের নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘানের জন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরী।
শুনানি শেষে সিএমএম আদালতের হাকিম ইউনুস খান আসামিদের ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন। রিমান্ডে প্রেরিত জেএমবি সদস্যরা হচ্ছেন, আবু সাঈদ ওরফে রাসেল ওরফে সালমান (২২), ইলিয়াস ওরফে ওমর ফারুক (২৩) ও মোহসীন আলী ওরফে রুবেল (২০)। আবু সাঈদের বাড়ি দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানা এলাকায়। ইলিয়াসের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। আর মোহসীনের বাড়ি জয়পুরহাটে।
তদন্ত সংস্থার এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, মিরপুরের গ্রেনেড তৈরির কারখানাটি প্রায় ৪ মাস আগে স্থাপন করে জেএমবি। পলাতক দুজন মূলত গ্রেনেড তৈরির প্রশিক্ষক। তারা সেখানে গ্রেনেড তৈরির কলাকৌশল শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি গ্রেনেড তৈরি করে মজুদ করে রাখত। এ জন্য বাসাটির ছয়তলার পেছনের দিকের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় তারা। আর পরিকল্পিতভাবেই জেএমবি সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন করে। তারা নিজেদের মিরপুর সরকারী বাঙলা কলেজের ছাত্র পরিচয়ে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। ভাড়া নেয়ার কিছুদিন পর থেকেই সেখানে গ্রেনেড তৈরি, প্রশিক্ষণ, মজুদ ও সরবরাহ করা শুরু করে।
ইতোমধ্যেই কারখানাটি থেকে তৈরিকৃত অনেক গ্রেনেড ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকা জেএমবি সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তবে তার পরিমাণ কত সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য দেয়নি গ্রেফতারকৃতরা। প্রতি চালানে ৪ থেকে ৫টি করে গ্রেনেড সরবরাহ করা হতো।
এই কারখানার তৈরি গ্রেনেড দিয়েই হোসেনী দালানে হামলা হয়েছে। সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। আর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর মসজিদেও হামলায় মিরপুরের কারখানায় তৈরি গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়েছে বলে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং প্রাপ্ত তথ্যে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।
তদন্তকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি সদস্যরা নাশকতা চালানোর আগে টার্গেটকৃত জায়গা প্রথমে নির্ধারণ করে। এরপর সেখানে অনেক আগে বাসা ভাড়া নেয়। বাসা ভাড়া নিয়ে টার্গেটকৃত জায়গার ওপর নজরদারি করতে থাকে। হামলার সপ্তাহখানেক আগে তারা চূড়ান্ত রেকি করে। এরপর হামলা চালানো হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে গ্রীন সিগন্যাল পেলেই কারখানা থেকে গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়। হোসেনী দালানে হামলার ক্ষেত্রেও নাশকতা চালানোর সপ্তাহখানেক আগে গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়। মিরপুর থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ডগ্রেনেড আর হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে হামলায় ব্যবহৃত হ্যান্ডগ্রেনেড এক ও অভিন্ন। শুধু মিরপুর নয়, চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর মসজিদে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডও মিরপুরের কারখানায় তৈরি বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, বিদায়ী বছরের ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলী আমিনবাজার ব্রিজের ঢালে চেকপোস্টে দায়িত্বরত অবস্থায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় ঢাকার দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে। এ সময় গ্রেফতার হয় বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাথী মাসুদ রানা। মাসুদ রানা জানায়, বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি কামাল ওরফে প্রকাশ পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
মাসুদ রানার তথ্যমতে, ওই রাতেই ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে ৫টি হ্যান্ডগ্রেনেডসহ এক জামায়াত নেতা ও তার দুই ছেলে ছাত্রশিবিরের সক্রিয় কর্মী গ্রেফতার হয়। কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ডগ্রেনেড আর চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলা করে ২ জনকে হত্যা এবং দেড় শতাধিক আহত করার ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ডগ্রেনেড এক ও অভিন্ন। মিরপুরের গ্রেনেড তৈরির কারখানা থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ডগ্রেনেড আর হোসেনী দালানে ব্যবহৃত হ্যান্ডগ্রেনেড এক ও অভিন্ন বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, বিদায়ী বছরের ১৮ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে অন্তত ছয়জন আহত হন। এ ঘটনায় অস্থায়ী সদস্য রমজান আলী ও আব্দুল মান্নান নামে দুইজন আটক রয়েছে। তারা হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।