
ছবি: জনকণ্ঠ
সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাইভেট পড়তে যেতাম, বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে স্কুলে যেতাম।
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে স্কুল জীবনের কথা। সারাদিন স্কুলে হৈ-হুল্লোড় করতাম আর ক্লাসের সময় ক্লাস করতাম। স্কুল শেষে বাসায় ফিরে কখনো খেয়ে, বেশির ভাগ দিন না খেয়ে খেলাধুলায় মাঠে চলে যেতাম।
তবে বাসায় পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় আমাদের ক্রিকেট টিম গঠনের কাজ শেষ হয়ে যেত। কোনোদিন রাস্তায় টসও সেরে ফেলতাম যেন মাঠে গিয়ে সময় নষ্ট না হয়।
খেলার মাঠে দাপট দেখালেও পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলাম না।
সন্ধ্যার আজানের (মাগরিব) সঙ্গে সঙ্গে খেলা বন্ধ করে ব্যাট-বল হাতে বাসায় ফিরতাম সবাই।
সন্ধ্যার পর আর বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন আমাদের কারো মোবাইল ফোনও ছিল না। তারপরও সবাই একসাথে হতে পারতাম খুব সহজেই। কিন্তু এখন সবার হাতে ফোন—যোগাযোগ ভালো, তবুও একসাথে হওয়া হয় না।
মাঝেমধ্যে রাতে আকমল মামা (সবার বাসায়) এসে আমাদের খোঁজখবর নিতেন—আমরা পড়ছি নাকি ঘুমিয়ে পড়েছি।
একদিন সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আকমল মামা হঠাৎ বাসায় এসে দেখে আমি ঘুমিয়ে গেছি। ঘুম থেকে ডেকে তুলে পড়ার টেবিলে বসিয়ে তারপর চলে গেলেন।
আকমল মামা আমাদের খুব আদর আর শাসন করতেন। তিনি আমাদের নিয়ে খেলাধুলা, পড়াশোনা এমনকি মাঝেমধ্যে পিকনিকেরও আয়োজন করতেন। আমি, জাকারিয়া, জাহিরুল (মামাতো ভাই)—প্রায়ই একসাথে থাকতাম। বাসা পাশাপাশি থাকার সুবাদে আমরা রাতেও একসাথে থাকতাম। জাকারিয়া ও জাহিরুলের সঙ্গে আমি কখনো দাবায় জিততে পারতাম না। বৃষ্টির দিনে ধনী হওয়ার মজার খেলা খেলতাম।
তখন আমাদের আড্ডা হতো বই কেন্দ্রিক। কোন বইয়ের কোন পাতায় কী আছে—এসব নিয়ে গল্প করতাম।
মাঝে মাঝে (শুক্রবার) আমরা সাইকেল নিয়ে সারাদিনের জন্য ঘুরতে যেতাম। তখন কাছে টাকা না থাকলেও অনায়াসে দিন কেটে যেত।
বাসায় বিদ্যুৎ না থাকায় বাতির আলোতে আমাদের পড়তে হতো। তখন খারাপ লাগত, অন্যরা বিদ্যুতের আলোতে পড়ে, আর আমরা বাতি বা হারিকেনের আলোতে। এখন সেই বাতির আলো খুব মিস করি।
আমার ছোট মামা (লুৎফর রহমান) আমাকে নানুর ফোনে ফোন দিয়ে অনেক পরামর্শ দিতেন। খেলাধুলায় তিনি খুব সহযোগিতা করতেন, কিন্তু পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন খুবই কড়া। তিনি ঢাকায় চাকরি করেন।
নানুর বাসায় থেকে পড়ার সুযোগ হয়েছিল, মাঝে মাঝে বাসায় বেড়াতে আসতাম।
ক্রিকেটের কোনো ম্যাচ থাকলে মামাতো ভাইয়েরা সাইকেল নিয়ে আমাকে নিতে আসত।
দাদু-দাদিকে হারিয়েছি অনেক আগেই, সম্ভবত তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম।
ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয়নি। তারপরও স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমরা হারাই প্রিয় প্রধান শিক্ষক রেজাউল করিম (রেজা স্যার) কে।
আমাদের বিদ্যালয় ছিল টিনের তৈরি। ২০১৪ সালে বিদায় অনুষ্ঠান হয় নতুন অডিটোরিয়ামে।
বন্ধুদের মধ্যে বক্কার, রবিন, সাগর, শিহাব, জাকারিয়া, মনসুর, নাজমুল, রিয়াজুল, আলীম (মামা) ছিলো অন্যতম। সবাই এখন ব্যস্ত। কেউ বিয়ে করেছে, কেউ সরকারি চাকরি করছে, কেউ ব্যবসা করছে।
বান্ধবীদের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষার পর আর যোগাযোগ হয়নি। শুনেছি সবাই বিয়ে করে ফেলেছে।
স্কুলে মারামারি হতো অনেক, খেলার মাঠে তো লেগেই থাকতো। আমি লেখা-পড়ায় কাঁচা ছিলাম, হাতের লেখাও খুব খারাপ ছিল।
মনে আছে, সপ্তম শ্রেণির শেষ ক্লাসে আমার কয়েকজন বন্ধু বেঞ্চে লাথি মারছিল, কেউ টিনের বেড়া থাপড়াচ্ছিল। এমন সময় উপস্থিত হন সহকারী প্রধান শিক্ষক মোতালেব হোসেন স্যার—যাকে আমরা "টাইগার স্যার" বলতাম। আমি রক্ষা পেয়েছিলাম কারণ ওদের সাথে তাল মিলাইনি।
বাসা থেকে স্কুলের পথ অনেক দূর ছিল বলে আমি আর জাকারিয়া শর্টকাট রাস্তা—ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে যেতাম।
কৃষকেরা (আমিও কৃষক পরিবারের সন্তান) যখন পাট চাষ করতো, তখন পাট গাছ ১২-১৪ ফুট লম্বা হতো, যা জঙ্গল মনে হতো। বর্ষাকালে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট তুলে, জুতা হাতে নিয়েই স্কুলে যেতাম, তবুও যাওয়া বন্ধ করতাম না।
রবিন, শিহাব, সাগর আর আমি একসাথে স্কুলে যেতাম। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি বেঞ্চ থাকত।
নানুর বাসায় থাকার কারণে এলাকার অনেকেই সম্পর্কে আমার মামা ছিল। মামাতো ভাইয়ের অভাব ছিল না।
নানুর বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। গ্রীষ্মকালে দিনে ভালো লাগলেও গভীর রাতে গরমে ঘুমানো কঠিন হতো। বাড়ির চারপাশে ৭-৮ একর জায়গা জুড়ে বাগান ছিল।
আমার, জাহিরুল, জাকারিয়া ও আমিরুল—সবাই একই স্কুলে পড়তাম। আমিরুল ও জাহিরুল এক বছরের জুনিয়র হলেও আমরা বন্ধু ছিলাম।
জাহিরুলের হাতের লেখা ছিল দারুণ, কিন্তু পিএসসি’র পর আর ভালো ছাত্রের কাতারে থাকতে পারেনি। আমি তো এমনিতেই লাস্ট বেঞ্চার ছিলাম।
একবার মোতালেব স্যার আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে বেত দিয়ে মারেন। শিহাব নামের বন্ধুটি রাস্তাও ভুলে যায়, রবিনদের সঙ্গে পুষ্পপাড়া চলে গিয়েছিল।
সব বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে, বাকি ২-৪ জন। আমি সব বিয়েতে গিয়েছি। অনেকেই বাবা হয়ে গেছে। আমি বিনা পয়সায় দাওয়াত খেতাম।
স্কুল পালানো শিখেছিলাম অষ্টম শ্রেণিতে। অফিস রুমের পাশ দিয়ে মানব পাড়ি দিয়ে পালাতাম। পরে হাতের তালু ফুলে যেত।
অষ্টম শ্রেণির নির্বাচনীতে গণিতে ফেল করেছিলাম। শিক্ষকরা সবাই আমাদের অপমান করেছিলেন, তবে সেটাও শিক্ষণীয় ছিল।
তখন স্কুলে বিদ্যুৎ থাকলেও কেবল অফিসসহ ৩টি রুমে ফ্যান ছিল। ২০১৪ সালের পর স্কুল সয়ংসম্পূর্ণ হয়, আমরা তখন বিদায় নিয়েছি।
একদিন বিকেলে ব্যাট-বলের ফাইট চলছে, এমন সময় আলীম মামা হাজির। তিনি বললেন, “মামা, জেএসসি রেজাল্ট দিয়েছে আজকে জানো না?” আমি আর জাকারিয়া অবাক। বললাম, "ভালো ছাত্র না, রেজাল্ট দেখেও কি হবে!"
তারপরও স্কুলের দিকে রওনা হলাম। কারো ফোন ছিল না, অনলাইনের খবরও জানতাম না। খেলা ছেড়ে ৪টার দিকে স্কুলে গেলাম। আলীম মামার ফোন থেকে মোতালেব স্যারকে ফোন দিয়ে রেজাল্ট জানলাম—আমি কোনোভাবে পাশ করেছি।
বাসায় গিয়ে সবাইকে জানালাম, পাশ করেছি—রেজাল্ট ভালো হয়নি। নানী বললেন, “পাশ করেছিস, সেটাই অনেক।” পরদিন নবম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম।
আলীম মামা এখন রূপালী ব্যাংকে চাকরি করেন। জাকারিয়া ঢাকায় একটি সুনামধন্য কোম্পানিতে কাজ করছে।
উল্লেখযোগ্য, আমাদের বন্ধু আবু বকর দারুণ গান গাইত। সে ছিল ক্লাসের বিনোদনের মূল আকর্ষণ।
মুমু