ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ জহীরের রোশনাই এবংইন্দো-পাক উপমহাদেশে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন

সোহেল মাজহার 

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৪ মার্চ ২০২৪

সাজ্জাদ জহীরের রোশনাই এবংইন্দো-পাক উপমহাদেশে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন

সৈয়দ সাজ্জাদ জহীর

ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈয়দ সাজ্জাদ জহীর সংক্ষেপে সাজ্জাদ জহীর। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, চিন্তক ও সাংবাদিক। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এবং গণমানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করেছেন। সূচনা হয়েছিল ১৯১৯ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদানের মাধ্যমে। পরবর্তীতে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন ও পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, উপনিবেশবাদ, জার্মান, জাপান ও ইতালির ফ্যাসিবাদের প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবী ব্যাপী উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা ও গণমুক্তির আকাক্সক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। গণমুক্তির আকাক্সক্ষা নিয়ে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ ও উপনিবেশ বিরোধী লেখক, শিল্পী- সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদগণ ঐক্যবদ্ধ হয়, প্রতিবাদী লেখা- সম্মেলনের আয়োজন করে।

একই সময় ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লব ও কমিউনিস্ট ঘরানার লেখার প্রভাবে দেশে-দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। যার প্রভাব লন্ডনেও পড়েছিল। ১৯০৫ সালে লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয় কিছু শিক্ষার্থী ড. মূলক রাজ আনন্দ, প্রমোদ সেনগুপ্ত, ড. মোহাম্মদ দ্বীন তাসির, হীরেণ মুখার্জি, ড. জ্যোতি ঘোষ ও সৈয়দ সাজ্জাদ জহীর লন্ডনে বসে একটি প্রগতিশীল সংগঠন গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে তাঁরা প্রাথমিক খসড়াও তৈরি করেন। সমমনা ছাত্র, লেখক ও রাজনীতিবিদের মধ্যে তা বিতরণ করেন। 
বাস্তবতা হলো তাঁদের মধ্যে সাজ্জাদ জহীর খুব দ্রুত ভারত চলে আসেন। তিনি সমমনা বন্ধু, লেখক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন দাঁড় করানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। 
তাঁর কর্মপ্রচেষ্টার ফলে ১৯৩৬ সালে লক্ষেèৗতে প্রথম নিখিল ভারত প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনেই তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে ওঠেন মূল সংগঠক। এ প্রসঙ্গে আহমেদ আলী খান উল্লেখ করেন ‘সাজ্জাদ জহীরের কোনো কোনো সঙ্গী, যেমন- তাসির ও প্রফেসর আহমাদ আলী তাঁর থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্রভাবে স্ব স্ব জায়গায় ভূমিকা পালন করেন।

কলকাতার প্রগতিশীলগণ ওখানেই তাঁদের কর্মকা- সীমিত রাখেন। মূলক রাজ আনন্দের আন্দোলনে সমর্থন ছিল, কিন্তু তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেননি। প্রেমচাঁদ বিহারে প্রগতি আন্দোলন শুরু করতে সাহায্য করেন। কিন্তু মারা যান। এভাবে জ্যেষ্ঠদের মধ্যে সাজ্জাদ জহীর মূলত একা হয়ে পড়লেন। একাই তিনি সংগঠনটিকে দাঁড় করানোর দায়িত্ব পালন করে গেলেন।

তাঁকে সমর্থন করে যাঁরা তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেন, তাঁরা হলেন ড. রাশীদ জাহান ও তাঁর কীর্তিমান স্বামী মাহমুদুজ্জাফর, তরুণদের মধ্য থেকে ফায়েজ, সরদার জাফরি, সিবতে হাসান, মাখদুম মহীউদ্দীন এবং ১৯৪৭-এর পরে আহমেদ নাদিম কাসমী। কাজেই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সংগঠনটির অগ্রগতি সাজ্জাদ জহীরের সাংগঠনিক দক্ষতা, দৃঢ় প্রত্যয় ও চারিত্রিক কারিশমার কারণে সম্ভব হয়।’ (তথ্যসূত্র : পৃঃ ১২ ও ১৩, রোশনাই : ইন্দো- পাক উপমহাদেশে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাস,) 
সাজ্জাদ জহীর ও তাঁর বন্ধুদের নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার ফলে শুধু উর্দু ও হিন্দি বলয়ে নয়, ভারতের প্রধান ১৫টি ভাষা ও ভাষাভাষী অঞ্চলেও প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের সাংগঠনিক রূপ দাঁড়িয়ে যায়। ভারতের প্রায় সবকটি ভাষাভাষী সাহিত্য ও সংস্কৃতির লেখক সাহিত্যিক চিন্তাবিদগণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। স্বভাবত ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি নিখিল ভারত সম্মেলন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
৪৭-এর দেশভাগের পর তাঁকে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি পাকিস্তান চলে যান। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে সরকার তাঁকে এবং ফায়েজসহ অনেককে ১৯৫১ সালের রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়।  হায়দ্রাবাদ (সিন্ধু), নাটোরে, মাচ ও কোয়েটায় সাড়ে চার বছর জেলে ছিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় নিজের স্মৃতি থেকে ইন্দো- পাক উপমহাদেশে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাস নামে একটি গ্রন্থ লিখেন। নাম রোশনাই। বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় ভোরের আলো। 
কার্যত সাজ্জাদ জহীর গ্রন্থটিতে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের প্রাথমিক অবস্থা, বিশ্ব রাজনীতি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার বিশ্লেষণের পাশাপাশি ভারতের রাজনীতি, সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। একই সঙ্গে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনে তাঁকে এবং উদ্যোক্তাদের কী ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈরি পরিবেশ মোকাবিলা করতে হয়েছে তার বর্ণনা আছে।

ভারতীয় কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ ফুটে ওঠে। একইসঙ্গে জওহরলাল নেহেরু, সরোজিনী নাইডু, মাওলানা হাসরাত মোহানী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ আহমদ খান, দেওবন্দ আন্দোলন, আলীগড় আন্দোলন, সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি গঠন, ম্যাক্সিম গোর্কি স্মরণ সভা, প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠনের সমান্তরালে পিপলস থিয়েটার গঠন,  হিন্দু-মুসলিম মানস ও উর্দু-হিন্দির ভাষাগত প্রতিযোগিতা ও আধিপত্যের বিষয়গুলোও প্রতিফলিত হয়েছে। আবার  ৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কের অবনতির বিষয়গুলো যথাযথভাবে আলোচনা হয়েছে। 
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্য ও পাঠকমহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলে। বইটি বিভিন্ন ভাষায় বহুবার অনূদিত প্রকাশিত হয়েছে। কখনো এর আবেদন কিংবা প্রাসঙ্গিকতা হারাবে না। বিশেষত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের অবস্থান, গতি প্রকৃতি ও উৎসমুখ উপলব্ধি করতে আকরগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।  বাংলায় বইটির অন্বুাদ করেছেন এলহাম হোসেন। তিনি একাধারে লেখা, গবেষণা, অনুবাদ ও মৌলিক সাহিত্য  রচনা করেন। তাঁর গদ্য ভাষা, শৈল্পিক, প্রাঞ্জল ও সহজ- সরল। যে কোনো পাঠক খুব সহজেই লেখকের বক্তব্য ও অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ পাবে। 
বইয়ের আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো বইটিতে লেখকের মুখবন্ধ, আহমেদ আলী খানের ভূমিকা, উর্দু সংস্করণে সিবতে হাসানের ভূমিকা, ইংরেজি সংস্করণে আমিনা আজফারের ভূমিকা স্থান পেয়েছে। একই সঙ্গে অনুবাদ এলহাম হোসেন একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন, যা বইটি পাঠে পাঠককে সাহায্য করবে। এভাবেই বইটি এখনও হয়ে উঠেছে  প্রাসঙ্গিক। 
বইটি প্রকাশ করেছে বাঙ্গালা গবেষণা, প্রচ্ছদ মোস্তাফিজ কারিগর, মূল্য ৭০০ টাকা। 
বইটির বহুল প্রচার ও পাঠ প্রত্যাশা করি।

×