ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

দুটি গল্প ॥ দিলুর সাইকেল

প্রকাশিত: ২১:৪১, ২৫ জুন ২০২১

দুটি গল্প ॥ দিলুর সাইকেল

ক্লাস শুরু হওয়ার পর ১০/১২ মিনিট চলে গেছে। স্যারের গিয়ার বাড়ছে। পুরো ক্লাসেই পিনপতন নীরবতা। ছেলেরা মুখিয়ে আছে স্যারের দিকে, পারলে এক ঢোকে গিলে খায় স্যারের কথা। হঠাৎ করে মে আই কাম ইন স্যার শব্দে আমাদের এক ঝাঁক চোখ পড়ল দরজার দিকে। দিলদার (দিলু) তাকিয়ে আছে স্যারের দিকে কাতর ভাবে পারমিশনের আশায়। একটা ছন্দ পতন হয়ে গেল পুরো ক্লাসে। স্যার বিরক্তির সুরে বললেন, তোমার কাল থেকে আর মে আই কাম বলার দরকার নাই, যখন আসবে চুপচাপ ঢূকে পড়বে। স্যার বিড় বিড় করে স্বগত বলছেন, ডিস্টার্বিং! দিলু মুখ কাঁচু মাচু করে আসামির মতো সাজা পেছনের সারিতে গিয়ে বসে পড়ল। দিলু প্রায়ই এ রকম লেইট করে। আর এতে করে ক্লাসে ডিস্টাব ঘটায়। একদিন তাকে রেগুলার লেটের কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে জানাল, দেখ ভাই বাসা থেকে কলেজে আসতে সাড়ে তিন মাইল পথের মাঝে যদি ৫/৬ বার সাইকেলের চেন পড়ে যায়, তবে কেমনে টাইম মতো ক্লাস ধরতে পারি। একবার চেন পড়লে চেনটা লাগাতে কত সময় লাগে। বার বার এ রকম চেন পড়ে কেন জানতে চাইলে সে বলল ফিরি উইলের তার নষ্ট হয়ে গেছে। খালুর কাছে গেলে ঠিক করে দেয় আবার দুই দিন পর যেই সেই অবস্থা। পয়সাও যায় কাম ও হয় না। ফিরি উইল সেট নতুন করে লাগাতে গেলে খালু বলে পয়সা রাখার জায়গা পাও না, অনেক টাকা লাগবে। কিন্তু এই যে ভেজাল, মেরামত করলেও ২/৩ দিনের বেশি টেকে না, পথের মধ্যে চেন পড়ে যায়, টাইম মতো ক্লাস ধরতে পারি না এত ঘটনা খালুকে কেমনে বোঝাই। আর বললেও খালু বোঝেও না, আর পাত্তা দেবে কি! মূল ঘটনা হচ্ছে, নতুন লাগালে তো রেগুলার মেরামত লাগবে না; আর ঠিক করা না লাগলে খালুরও ইনকাম বন্ধ। আমি ও এ বেটার ওপর জোর খাটাতে পারি না। আমার ছোট থেকে এ যাবত বড় হওয়া তার চোখের সামনে। ছোট বেলা থেকেই দিলু খালুকে একই রকম দেখে আসছে। ঘাড় ডান দিকে বাঁকা, ফিক্সড, মাথা সোজা হয় না, চোখ একটু টেরা, খস খস করে কথা বলে। নাম তার গেদু, গেদু মেকার হিসেবেই সবাই চিনে। সে আবার গেদু ভাই বলে কেউ ডাকলে মাইন্ড করে। ভাবসাবে বুঝিয়ে দেয়। আসল নাম গাফফার, এত বড় নামে ডাকাও যায় না। এখন কেউ ডাকে মামা, কেউ চাচা, কেউ ভাই যে যেভাবে আরাম পায়। আমি ডাকি খালু। কিন্তু মামার আগে গেদু জুড়ে দিলেই কপাল কুচকে চোখ বাকা করে তাকায়। রিক্সা সাইকেল, ঠেলা গাড়ির মেকার এই গেদু মিয়া। দিলুর বাসার কাছেই রাস্তার পাশে তার দোকান। গ্যারেজ প্রায় খোলা আকাশের নিচে, আধা তেরপাল, বাকিটা পলিথিন; জোড়া তালি দিয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা। বেশি বৃষ্টি বা বাতাস আসলে সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। তখন একদিকে তার হাতুড়ি, বাটাইল, রেঞ্জ সব যন্ত্রপাতি গোছগাছ করা অন্যদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া তেরপালিথিন কুড়িয়ে এনে এক জায়গায় স্ত‚প করে রাখা। হুড়োহুড়ি লেগে যায়। বর্ষার সময় প্রায়ই এ অবস্থা সামাল দিতে হয়। আকাশে মেঘ বা বাতাস একটু জোরে বইলেই গেদু মেকার তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে আগে থেকে রেডি হয়ে যায়। গ্যারেজের সামনে একটা ভাঙ্গা হেলান দেয়া বেঞ্চ। রিক্সাওয়ালারা এসে বসে, চা বিড়ি আর গুলতানি চলছে রিক্সা মেরামতের ফাঁকে। ওরাও একটু জিরিয়ে নেয়। চলে আড্ডা, হাসি-ঠাট্টা, সুখ-দুঃখের কথা, কে কয়টা ক্ষ্যাপ মারে, কোন্ যাত্রী ১০০ টাকার নোট দিয়ে বাকি টাকা ফেরত না নিয়ে চলে গেল, কে কয় টাকা দেশে পাঠাল ইত্যাদি নানা টপিক। একটু বড় হওয়ার পর দিলুও মাঝে মাঝে ওদের আড্ডায় যোগ দিত। তিন কাপ চা আসলে দুটো খালি কাপ। ৫/৬ কাপে ভাগ করে দিলুও এক ভাগ পেত। ভালই লাগত। নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হত। চায়ের ভাগ পেল কি না খালুও টেরা চোখে খেয়াল রাখত। রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া নিয়ে দিলু বাসাতে কত বকা খেয়েছে। কলেজে ভর্তির পর সাইকেলটা কিন্তু দিলু খালুর কাছ থেকেই কিনেছে। দাম দর করে খালু শেষমেশ তাকে ৭০ টাকায় সাইকেলটা দিয়েছে। নিজের মানুষ বলে তাকে ১০ টাকা কমে দিয়েছে, অন্য লোক হলে ৮০ টাকার পাচ পাইওকমে দিত না। দিলুও মনে মনে খুশি, খালুর প্রতি তার সম্মান আরও বেড়ে গেছে। খালুর এটাও আরেক ব্যবসা। এক সাইকেলের হ্যান্ডেল, আরেকটার ফ্রেম, চেন এ রকম নানা সাইকেলের চাকা, মাডগাড ইত্যাদি পার্টস জোড়াতালি দিয়ে খালু এ রকম আস্ত একটা সাইকেল খাড়া করে ফেলত; এরপর দিলুর মতো কাস্টমার বাগিয়ে যার কাছ থেকে থেকে যত খসানো যায় সেই দরে বেচে দিত। সবাইকে একই কথা, নিজের মানুষ বলে তোমার কাছে এত কমে ছেড়ে দিলাম।একবার যে খালুর বর্শিতে ধরা দিল তার আর সহজে ছাড়া পাওয়ার রাস্তা নাই। পুরনো সাইকেল একবার গছিয়ে দিতে পারলে গেদু মেকারের নতুন আরেক ব্যবসা শুরু। আজ সাইকেলের মাডগাড খুলে পড়ে যায়, কাল চেন খুলে পড়ে, এমনও হয়েছে মাঝ পথের মাঝে চাকা খুলে ড্রেনে চলে গেছে। মালিক চিৎপটাং রাস্তার ওপরে। দিলুরও এ রকম একবার হয়েছিল; পেছনের বেবিট্যাক্সি যদি ব্র্যাক না ধরত তা হলে দিলু মিয়া হয়ত চিরদিনের জন্য লেটে এর খাতায় নাম লেখাত। এমনও অনেক সময় রিক্সায় তুলে ভাঙ্গা সাইকেল গেদুর কারখানায় নিয়ে আসতে হতো। কারণ মেড ইন গেদুর সাইকেল সে ছাড়া আর কেউ মেরামত করতে পারে না; এমন এক কেরামতিতে সে সাইকেলটা তৈরি করে যে অন্য গ্যারেজে গেলে গেদুর নাম শুনলে কেউ এই সাইকেলে হাত লাগায় না। আর তার কাস্টমারদের মনেও এমন এক ধারণা জন্মিয়েছে যে গেদুর মতো এত বড় ওস্তাদ শহরে নেই। অবশেষে আমাদের অবাক করে দিলু মিয়া একদিন ক্লাস আরম্ভ হওয়ার আগেই ক্লাসে ঢুকে একেবারে প্রথম বেঞ্চে জায়গা করে নিল। ক্লাসের পর দিলুর কাছে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, এটা কি করে সম্ভব! দিলুর ভাবে মনে হোল, দেরিতে আসলেও দোষ, আজকে আগে আসায় যেন আরও বড় অপরাধ হয়ে গেছে। দিলু আমতা আমতা করে বলল, আগের সাইকেলটা বেচে দিয়েছে। খালুকে না জানিয়ে বিক্রি করায় সে এখন তাকে দেখলে বাঁকা ঘাড় থাকায় পুরো শরীর ঘুরিয়ে কথা না বলে চলে যায়। নিত্যদিনের সাথী সাইকেলটা ছেড়ে দেয়ায় দিলুর মনেও একটা ব্যাথা তার কথার স্বরে বোঝা যাচ্ছে। এতদিনের সাথী সাইকেল আর সাথে খালুকেও হারিয়ে দিলুকে আজ বড় নিসঙ্গ, অসহায় মনে হচ্ছে।
×