
কখনো এককালের সহিংসতার খবরের কেন্দ্রে থাকা জর্জিয়ার পাংকিসি উপত্যকা আজ পর্যটকদের জন্য শান্তি, সুফি রীতি, পাহাড়ি পথ এবং ঘরোয়া কিস্ট খাবারের আতিথেয়তায় স্বাগত জানাচ্ছে।
দুই দশক আগে যেখানে পর্যটকরা পা রাখতেও ভয় পেত, আজ সেই সবুজ উপত্যকায় সূর্যস্নাত কাঠের বাড়ি, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করা আরবি ও চেচেন সুরের ধিকির (ধিকর), এবং অতিথিদের হাতে তুলে দেওয়া ঘরের খাবার যেন এক অন্য পৃথিবীর গল্প বলে।
সুফি ধিকর: নারীর কণ্ঠে স্মরণের সুর
দুই পায়ে ভর দিয়ে গোল হয়ে বসে থাকা নারীরা শুরু করেন ধিকর — আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘স্মরণ’, যা আল্লাহর নিকট আত্মা পৌঁছানোর একটি সুফি পদ্ধতি। পাংকিসির দুইসি গ্রামে, পুরো ককেশাসে একমাত্র এখানেই নারীরা পুরুষদের মতো মসজিদে ধিকর করেন।
ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর বাড়ে, তাল মিলিয়ে তারা ঘুরতে থাকেন। একটি প্রবীণ নারীর কপালে ঘাম জমে, কিন্তু থামেন না। তালের সাথে ঘুরে চলেন—এক আত্মমগ্ন ধ্যানময় পরিবেশে।
পাংকিসির অতীত: ভুল বোঝাবুঝির ইতিহাস
২০০০-এর দশকে, রাশিয়ার চেচনিয়া যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা আশ্রয় নেন পাংকিসি উপত্যকায়। কিন্তু এর সঙ্গে আসে আতঙ্ক — বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া আল-কায়েদা বা এমনকি ওসামা বিন লাদেনের উপস্থিতির গুজব ছড়ায়।
এরপর, জর্জিয়ান সরকার আন্তর্জাতিক চাপের মুখে 'সন্ত্রাস দমন অভিযান' চালায়, কিন্তু স্থানীয়দের জন্য কোন টেকসই উন্নয়ন হয়নি। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ২০১০-এর দশকে আইএসআইএস প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আনুমানিক ৫০ থেকে ২০০ জন পাংকিসি বাসিন্দা সিরিয়ায় পাড়ি জমান। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবু ওমর আল-শিশানি, যিনি আইএসের শীর্ষ নেতা ছিলেন। তাঁর কারণে বিশ্ব মিডিয়া আবারও পাংকিসিকে 'সন্ত্রাসের কেন্দ্রস্থল' হিসেবে চিত্রায়িত করে।
নতুন পরিচয়: শান্তি, সংস্কৃতি ও আতিথেয়তা
তবে আজকের পাংকিসি সেই পুরনো ছায়া পেছনে ফেলে এসেছে আতিথেয়তা, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির দ্বারপথে। ডেনিশ ইমিগ্রেশন মন্ত্রণালয়ের ২০২০ সালের রিপোর্টেও বলা হয়েছে:
"পাংকিসিতে অপরাধের হার খুবই কম, এটি একটি শান্তিপূর্ণ অঞ্চল।"
স্থানীয় গাইড ফাতিমা বলেন, “আমি যখন ত্ববিলিসিতে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই, তখনও অনেকে ভাবতো পাংকিসি নিরাপদ না। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা একেবারেই আলাদা।”
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
-
কীভাবে যাবেন: ত্ববিলিসির ওর্টাচালা স্টেশন থেকে প্রতিদিন মিনিবাস যায়।
-
সেরা সময়: মে থেকে অক্টোবর।
-
থাকার জায়গা: দুইসি ও জোকোলো গ্রামে ৯টি গেস্টহাউজ, স্থানীয় পরিবার পরিচালিত।
-
কী করবেন: হাইকিং, ঘোড়ায় চড়া, সুফি ধিকর দেখা, কিস্ট খাবার রান্না শেখা, ফোকশিল্পের কাজ শেখা।
কিস্ট সংস্কৃতি ও খাবার
কিস্টরা মূলত চেচেন বংশোদ্ভূত সুফি মুসলিম সম্প্রদায়, যাদের ভাষা, গান, রীতিনীতি এবং রান্না জর্জিয়ার মূলস্রোতের চেয়ে অনেক আলাদা।
কিস্ট খাবার যেমন –
-
Zhizhig galnash: মাখা আটার বল ও নরম ভেজানো খাসির মাংস
-
Khinkali: ঐতিহ্যবাহী জর্জিয়ান ডাম্পলিং, তবে এখানে মাংস নয়, বিচি ও শাকপাতা ব্যবহার করা হয়
নাজি ডাকিশভিলি ছিলেন এই অঞ্চলের প্রথম গেস্টহাউজ উদ্যোক্তা, যিনি ২০১৩ সালে "Nazy's Guesthouse" খোলেন এবং পর্যটকদের এখানে নিয়ে আসার জন্য বহু বছর পরিশ্রম করেন।
একান্ত অনুভব
শেষ গ্রাম পেরিয়ে যখন রাস্তা থেমে যায়, সেখানে শুধু থাকে ককেশাস পাহাড়ের দেওয়াল, সবুজ গালিচার মতো মাঠ, ও নির্ভেজাল আকাশ। শিশুদের উচ্ছ্বাস, প্রাপ্তবয়স্কদের চা-ভরা আতিথেয়তা এবং লোকজনের ইংরেজিতে বলা "Where are you from?" — সব মিলিয়ে এক মানবিক ঘনিষ্ঠতার ছবি।
উপসংহার
পাংকিসি উপত্যকা আজ সন্ত্রাসের ছাপ মুছে ফেলে শান্তি, সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা হয়ে উঠছে। এখানে আসা মানে শুধু একটি স্থান দেখা নয়, বরং একটি ভুল বোঝানো জনগোষ্ঠীর মানবিক গল্পে শরিক হওয়া।
Jahan