
ছবি: সংগৃহীত
ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট (B-2 Spirit) বোম্বার বিমানটি বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে এখন। এর ‘স্টেলথ’ (Stealth) প্রযুক্তি আধুনিক বিমান যুদ্ধের এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে বিমানটিকে। কিন্তু আসলেই কি এটি অজেয়?
এর উত্তর হ্যাঁ এবং না। এখন পর্যন্ত অজেয় বলা যায় একারণে যে, একে ধ্বংস করতে যে মানের প্রযুক্তি ও খরচ করা প্রয়োজন তাতে পিছিয়ে আছে অন্য সবাই। আর অন্যদিকে অজেয় বলা যায়না কারন অন্যরা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকলেও এটি দূর্বলতা মুক্ত নয়। সেই সাথে এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর আকাশছোঁয়া নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ একটি বড় দুর্বলতা। মাত্র ২১টি বিমান থাকার কারণে এর সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতাও আছে।
এটিকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি শত্রুর রাডার ব্যবস্থায় সহজে ধরা না পড়ে। এর একটি বিশেষত্ব এর ‘ফ্লাইং উইং’ (Flying Wing) ডিজাইন, এর কোনো প্রচলিত ফুসেলেজ বা লেজ নেই, এবং এর পৃষ্ঠে বিশেষ ধরনের রাডার-শোষণকারী পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, যা রাডার সিগন্যালকে শোষণ করে বা অন্য দিকে প্রতিফলিত করে কিংবা বিভ্রান্ত করতে পারে। এটি প্রচলিত এবং পারমাণবিক উভয় ধরনের বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে সক্ষম এবং বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে পারে। কীভাবে এটি তৈরির ভূত চেপেছিল মার্কিনিদের?
১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, সামরিক বিমান ডিজাইনাররা ‘স্টেলথ’ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন, যা বিমানকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইন্টারসেপ্টর থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে একটি বিমান তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয় যার কাঠামো রাডার সংকেতকে প্রতিহত বা শোষণ করবে, যাতে রাডার ইউনিটে সামান্যই প্রতিফলিত হয়। এর ফলে বিমানটি প্রায় অদৃশ্য হয়ে উড়তে পারবে এবং রাডার-নির্ভর অস্ত্র ও সিস্টেম দ্বারা আক্রান্ত হবে না।
বি-২ বোম্বারের নকশা ও উন্নয়নের কাজ শুরু হয় কার্টার প্রশাসনের অধীনে ‘অ্যাডভান্সড টেকনোলজি বোম্বার (ATB)’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে। রেগান প্রশাসনের অধীনেও এর নকশার কাজ চলতে থাকে। মার্কিন কংগ্রেস এবং পেন্টাগনে এই প্রকল্পের উচ্চ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে।
বি-২ স্পিরিট প্রাথমিকভাবে ডিজাইন করেছে নর্থরপ কর্পোরেশন (Northrop Corporation), যা পরবর্তীতে নর্থরপ গ্রুম্যান (Northrop Grumman) হয়ে যায়। বোয়িং, হিউজেস এবং ভট-এর মতো কোম্পানিগুলো এর প্রধান সাথে কাজ করেছে। ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এর উৎপাদন চলে এবং ১৯৯৭ সালে এটি মার্কিন বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়। মোট ২১টি বি-২ বোম্বার নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে ২০টি বর্তমানে সচল আছে।
এর ব্যয় ছিল আকাশচুম্বী। বি-২ স্পিরিট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সামরিক বিমানগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতিটি বি-২ বোম্বারের নির্মাণ খরচ ২.১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অত্যন্ত বেশি, কারণ এর স্টেলথ প্রলেপ এবং অন্যান্য অত্যাধুনিক সিস্টেমের নিয়মিত যত্ন নিতে হয়। মূলত স্নায়ুযুদ্ধের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণে এর উৎপাদন পরিকল্পনা ছেঁটে ফেলা হয়। প্রাথমিকভাবে ১৩২টি বিমান তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত মাত্র ২১টি তৈরি করা হয়।
এই বোম্বারের যে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতাগুলো একে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সামরিক বিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তা হলো এর স্টেলথ প্রযুক্তি যা প্রতিপক্ষের রাডারকে ফাঁকি দিতে সক্ষম, দূরপাল্লার জন্য উপযোগি যা প্রায় রিফুয়েলিং ছাড়াই প্রায় ১১,১০০ কিলোমিটার (৬,৯০০ মাইল) পথ পাড়ি দিতে পারে এবং একবার রিফুয়েলিংয়ের মাধ্যমে ১৬,১০০ কিলোমিটার (১০,০০০ মাইল) এরও বেশি পথ উড়তে পারে। এটি বিশ্বের যেকোনো স্থানে হামলা চালাতে সক্ষম করে তুলেছে। আর সাথে আছে প্রচুর অস্ত্র বহনের ক্ষমতা যা এটি প্রায় ১৮ মেট্রিক টন (৪০,০০০ পাউন্ড) পর্যন্ত অস্ত্র বহন করতে পারে। এটি ‘বাঙ্কার বাস্টার’ (GBU-57) বোমা বহন করতে সক্ষম একমাত্র বিমান।
এই বি-২ বোম্বারের স্টেলথ প্রযুক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বের অন্যান্য সামরিক শক্তিগুলোও পাল্টা ব্যবস্থা তৈরি করছে তবে এখনো সেগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সি রাডার। স্টেলথ বিমানগুলো সাধারণত উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়। কিন্তু নিম্ন-ফ্রিকোয়েন্সি (যেমন ভিএইচএফ বা ইউএইচএফ) রাডারগুলো স্টেলথ বিমানের বৃহৎ কাঠামোকে সনাক্ত করতে পারে, যদিও এই রাডারগুলো লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান নির্ভুলভাবে নির্ধারণে কম পারদর্শী। চীন (যেমন JY-27V, YLC-8E) এবং রাশিয়া (যেমন Nebo-M) এই ধরনের অ্যান্টি-স্টেলথ রাডার সিস্টেমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
এছাড়াও আছে প্যাসিভ রাডার সিস্টেম। এই সিস্টেমগুলো নিজস্ব সংকেত নির্গত না করে পরিবেশের বিদ্যমান ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সংকেত ব্যবহার করে বিমানের উপস্থিতি শনাক্ত করে। এর ফলে এই সিস্টেমগুলো শনাক্ত করা কঠিন এবং জ্যাম করাও কঠিন। চীনের DWL002 এমন একটি উদাহরণ। এছাড়া ইনফ্রারেড সার্চ অ্যান্ড ট্র্যাক (IRST) সিস্টেম বিমানের নির্গত তাপ সনাক্ত করে স্টেলথ বিমানকে ট্র্যাক করতে পারে, বিশেষত যখন বিমান আফটারবার্নার ব্যবহার করে। রাশিয়ার Su-35 এর মতো আধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোতে উন্নত IRST সিস্টেম রয়েছে।
এই ধরনের বিমানের আরেকটি বিপদের কারণ হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক রাডার সিস্টেম, যা বিভিন্ন সেন্সর (রাডার, ইনফ্রারেড, অ্যাকোস্টিক) থেকে প্রাপ্ত বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করে বিমান শনাক্ত করতে পারে।
শনাক্ত করার পর এটিকে ধ্বংস করতে অবশ্য S-400 বা HQ-9-এর মতো দীর্ঘ-পাল্লার ভূমি-ভিত্তিক বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র (SAM) অথবা J-20 বা Su-57-এর মতো স্টেলথ যুদ্ধবিমান উন্নত এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে বি-২ কে ধ্বংস করতে পারে। তবে, এর জন্য লক্ষ্যবস্তুর নির্ভুল ট্র্যাকিং এবং সমন্বিত আক্রমণ ব্যবস্থা।
যা-ই হোক, এবার হয়তো এই ধরনের বিমান ঠেকাতে অন্য দেশগুলো মনোযোগ দেবে। আগামী এক যুগেই হয়তো নতুন কোন উদ্ভাবন বদলে দিবে যুদ্ধের প্রচলিত হিসাব-নিকাশ।
নয়ন আসাদ/রাকিব