ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ জুন ২০২৫, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফ্যাটি লিভারের প্রথম ইঙ্গিত হতে পারে পিত্তথলির পাথর!

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ১০ জুন ২০২৫

ফ্যাটি লিভারের প্রথম ইঙ্গিত হতে পারে পিত্তথলির পাথর!

ফ্যাটি লিভার ডিজিজকে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অনেক সময় ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে আখ্যা দেন। কারণ, এই রোগটি অনেক সময় কোনো লক্ষণ ছাড়াই শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখনই ধরা পড়ে, যখন তা গুরুতর জটিলতার দিকে এগিয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘মেটাবলিক ডিসফাংশন অ্যাসোসিয়েটেড স্টিয়াটোটি লিভার ডিজিজ’ (MASLD), যা আগে ‘নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ (NAFLD) নামে পরিচিত ছিল, তা বিশ্বের প্রায় ৩৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এই রোগের প্রাথমিক একটি লক্ষণ হতে পারে পিত্তথলিতে পাথর হওয়া, যা বহু সাধারণ হজমজনিত সমস্যার মধ্যে একটি।

পিত্তথলির পাথর ও ফ্যাটি লিভারের মধ্যে যোগসূত্র কী?

গবেষণায় দেখা গেছে, পিত্তথলির পাথর ও MASLD-এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যাদের পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ে, তাদের ক্ষেত্রে লিভারের সমস্যাও থাকার আশঙ্কা বেশি। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান হেলথের ট্রান্সপ্লান্ট হেপাটোলজি ফেলোশিপ প্রোগ্রামের পরিচালক ও মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. রবার্ট জে. ফন্টানা বলেন, ‘‘পিত্তথলির পাথর সাধারণত আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে ধরা পড়ে। আর এই পরীক্ষার সময় চিকিৎসকদের দৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই লিভারের দিকেও যায়।’’

পিত্তথলির পাথর আসলে কোলেস্টেরল বা বিলিরুবিন দিয়ে তৈরি শক্ত কণিকা, যা পিত্তথলিতে জমে থাকে। এটি এক ধরনের থলির মতো অঙ্গ, যা হজমে সাহায্যকারী তরল ‘বাইল’ সঞ্চয় করে রাখে। এই পাথরগুলি কখনও কখনও বালুকণার মতো ছোট বা গলফ বলের মতো বড় হতে পারে, তবে বেশিরভাগ সময়েই ছোট আকারে থেকে যায় এবং ব্যথা বা ব্লকেজ ছাড়াই শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।

বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পিত্তথলিতে পাথর গঠিত হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই কোলেস্টেরল-ভিত্তিক। গবেষণা বলছে, যাদের পিত্তথলিতে পাথর আছে, তাদের মধ্যে MASLD ধরা পড়ার হার ৩.৩ শতাংশ, যেখানে পাথর না থাকাদের মধ্যে এ হার মাত্র ১ শতাংশ।

MASLD এবং এর গুরুতর রূপ MASH (মেটাবলিক ডিসফাংশন অ্যাসোসিয়েটেড স্টিয়াটোহেপাটাইটিস) উভয়ই এক ধরনের মেটাবলিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, স্থূলতা এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস এই দুই রোগেরই মূল ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব মেটাবলিক সমস্যা শরীরে চর্বি প্রক্রিয়াজাত করার প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে। এর ফলে পিত্তথলিতে পরিবর্তন আসে এবং লিভারে চর্বি জমে যেতে শুরু করে, যা পাথর বা ফ্যাটি লিভারের জন্ম দিতে পারে।

ড. ফন্টানা বলেন, MASLD-এর পেছনে যে ঝুঁকিগুলো কাজ করে, সেগুলোই পিত্তকে ঘন করে তোলার প্রবণতা বাড়ায় এবং পাথর তৈরি হতে সাহায্য করে। তাই সরাসরি বলার চেয়ে বরং বলা যায়, এই দুটি সমস্যার একটি সাধারণ উৎস রয়েছে।

পিত্তথলির ব্যথা অবহেলা নয়, হতে পারে ফ্যাটি লিভারের সংকেত

যদিও এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, পিত্তথলির পাথর মানেই ফ্যাটি লিভারের সংকেত, তবে যদি এ সম্পর্কিত ব্যথা বা অস্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

MASLD ও গলস্টোন এড়াতে যা করবেন

বর্তমানে ফ্যাটি লিভারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষার সুপারিশ নেই, কারণ অনেক সময় সাধারণ টেস্টেও এই রোগ ধরা পড়ে না। ফলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

এনওয়াইইউ গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজিস্ট ড. প্রতিমা দিব্বা বলেন, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বজায় রাখা এবং স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করাই এই রোগ প্রতিরোধের মূল কৌশল। এই একই অভ্যাস পিত্তথলির পাথর, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও সহায়ক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি অভ্যাস MASLD এবং গলস্টোন প্রতিরোধে কার্যকর:

১. নিয়মিত শরীরচর্চা করুন

নিয়মিত শরীরচর্চা ইনসুলিন সংবেদনশীলতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং মেটাবলিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। হাঁটা, সাইক্লিং বা সাঁতার কাটার মতো অ্যারোবিক ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী। পাশাপাশি, ওজন তোলা বা অন্যান্য রেজিস্ট্যান্স ট্রেনিং লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে।

২. সুস্থ ওজন বজায় রাখুন

যদি আপনার ওজন ইতোমধ্যে স্বাভাবিক থাকে, তাহলে তা ধরে রাখা সবচেয়ে ভালো। অতিরিক্ত ওজন থাকলে ধীরে ধীরে ৭ থেকে ১০ শতাংশ ওজন কমালে লিভারে চর্বি জমা এবং প্রদাহ কমানো যায়। তবে হঠাৎ করে ওজন কমানো হলে বরং পাথর তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

৩. সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন

চর্বিজনিত খাবার পিত্তপাথর তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তাই পাম তেল, ক্রীম, মাখন, এবং অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়া এড়িয়ে চলা উচিত।

 

ফ্যাটি লিভার রোগ এখন এক নীরব স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে উঠেছে। এর প্রাথমিক সংকেত হিসেবে পিত্তথলির পাথরকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। যদিও দুইটি সমস্যার মধ্যে সরাসরি কারণ-ফল সম্পর্ক এখনো নিশ্চিত নয়, তবে যেকোনো পিত্তজনিত ব্যথাকে অবহেলা না করে, প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ যত তাড়াতাড়ি রোগ ধরা পড়বে, তত বেশি সম্ভাবনা থাকবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার।

 

 

 

সূত্র:https://tinyurl.com/4es8jv7z

আফরোজা

×