
ছবিঃ সংগৃহীত
বিশ্ব ইতিহাসে এমন সাম্রাজ্য খুব কমই রয়েছে যাদের প্রভাব তিনটি মহাদেশে বিস্তৃত হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল অটোমান সাম্রাজ্য—যা একসময় ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড শাসন করেছিল। প্রায় ছয়শো বছর ধরে টিকে থাকা এই সাম্রাজ্য শুধু যুদ্ধজয় নয়, উদারতা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্থাপত্যশৈলীতেও অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
উত্থান: আনাতোলিয়ার ছোট্ট রাজ্য থেকে মহাশক্তিতে পরিণতি
১৩ শতকের শেষভাগে বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ায় আবির্ভূত হন এক সাহসী নেতা—উসমান। মঙ্গোল আক্রমণে সেলজুক সাম্রাজ্য পতনের পর তিনি ধাপে ধাপে ছোট ছোট শহর জয় করে ১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অটোমান রাজ্য। সেই ছোট রাজ্যই পরে ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী মুসলিম সাম্রাজ্যে রূপ নেয়।
১৪৫৩: এক ইতিহাসের মোড়
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের একটি হল ১৪৫৩ সালের ২৯ মে—যেদিন সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ বিজয় করেন ঐতিহাসিক কনস্টান্টিনোপল শহর, যা পরে নাম পায় ইস্তানবুল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অজেয় থাকা বাইজান্টাইন রাজধানী দানবীয় "বাসিলিকা" কামানের গর্জনে কেঁপে ওঠে।
সেই শহরে হ্যাগিয়া সোফিয়া গির্জায় প্রথম নামাজ আদায় করে ফাতিহ ঘোষণা করেন—“খ্রিস্টানরা এ শহরে তাদের উপাসনা চালিয়ে যেতে পারবে।” এটি ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সোনালী যুগ: সুলতান সুলেমানের শাসন
১৫২০ সালে সিংহাসনে বসেন সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট। তিনি শুধু একজন যোদ্ধা নন, ছিলেন একজন বিচারপতিও। তাঁর রচিত "কানুননামা" আইনকানুনে পরিণত হয়। একইসঙ্গে তিনি অসাধারণ স্থাপত্যের অনুরাগী ছিলেন। ইস্তানবুলের সুলেমানিয়া মসজিদ আজও তার কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে।
পতনের শুরু: আধুনিকতার সাথে পা মেলাতে ব্যর্থতা
১৭০০ সাল থেকে ইউরোপে যখন বিজ্ঞান ও শিল্প বিপ্লব ঘটছিল, অটোমানরা তখন তাদের পুরোনো ঐতিহ্যের গর্বে পিছিয়ে পড়ে। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে অনীহা, সেনাবাহিনীর অতি শক্তিশালী হয়ে ওঠা এবং অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র—সব মিলে দুর্বল হতে থাকে সাম্রাজ্য।
১৮৬৩ সালে ভিয়েনা যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইউরোপ অটোমানদের "ইউরোপের অসুস্থ মানুষ" বলে অভিহিত করতে শুরু করে।
পতন ও নতুন সূচনা
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগদান করে অটোমানরা। যুদ্ধশেষে ১৯২২ সালে শেষ সুলতান দেশত্যাগ করেন। এক বছর পর জন্ম নেয় আধুনিক তুরস্ক, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। তিনি তুরস্ককে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন—নারীদের শিক্ষার সুযোগ দেন, ল্যাটিন হরফ চালু করেন এবং পাশ্চাত্য রীতিতে পোশাক সংস্কার করেন।
উত্তরাধিকার: ইতিহাসের পাতায় অম্লান
অটোমান সাম্রাজ্য আজ আর নেই, কিন্তু তার উত্তরাধিকার আজও জীবন্ত। ইস্তানবুলের পথে হাঁটলে দেখা যায় হ্যাগিয়া সোফিয়া, সুলেমানিয়া মসজিদ, ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপত্য—যা স্মরণ করিয়ে দেয় এক দুর্দান্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস।
যেমন করে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও তার আলো কিছু সময় আকাশে থেকে যায়, তেমনই অটোমান সাম্রাজ্যও তার কীর্তিতে অমর হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
আলীম