ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নূনা আফরোজ

কলকাতায় নুরুলদীনের সারাজীবন

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৬ অক্টোবর ২০১৬

কলকাতায় নুরুলদীনের সারাজীবন

রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতাটি শুনে খুব ছোটবেলায় বুঝে না বুঝে যেমন রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসেছিলাম, ঠিক তেমনি ছোট্টবেলাতেই নাটকটি বুঝতে পেরেছি কী পারিনি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ পড়ে এবং পরবর্তীতে দেখে সৈয়দ শামসুল হককে ভালবেসে ফেলেছি। সর্বদা ঝকঝকে এক উজ্জ্বল যুবক। ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে। জিন্সের প্যান্ট-শার্ট পরা পকেটে হাত রাখা সেই যুবকটিকে হাসপাতালের বেডে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কোন মতে চোখের জল লুকিয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই আমার ডান হাতটা দু’হাতে নিয়ে বললেন- ‘চোখের জল ফেলছ কেন? এই তো দুদিন পরেই আমি সুস্থ হয়ে যাব।’ সত্যি! আমার মনে হলো হ্যাঁ, তাইতো। খুব বিশ্বাস হলো কথাটি। হক ভাইকে দেখতেও বেশ ফ্রেশ লাগছিল, উজ্জ্বল লাগছিল। আমরা (আমি ও অনন্ত হিরা) অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা নাটকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই নাট্যকারের নাটক হোক ওপার বাংলাতেও । আমরা তো ওপার বাংলার নাট্যকারদের নাটক করি। তাহলে আমাদের নাটক কেন ওখানে হবে না? কয়েক বছর চেষ্টার পর ‘কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র’র দলপ্রধান কিশোর সেনগুপ্ত ‘নরুলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি করতে আগ্রহী হলেন। হক ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে নাটকটি করলেন। কথা ছিল প্রথম শো’তে হক ভাইকে গেস্ট করা হবে। আর আমরা তো থাকছিই। ২৫ আগস্ট প্রথম প্রদর্শনী হলো। কিন্তু হক ভাই তখন কর্কট ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে চিকিৎসারত। আর আমিও অসুস্থতার কারণে প্রথম প্রদর্শনী দেখতে যেতে পারলাম না। কিন্তু খুব অস্থির লাগছিল ভেতরে ভেতরে কেমন হলো প্রথম প্রদর্শনী জানার জন্য। নানাভাবে নানাজনের কাছে খোঁজ নিয়ে হক ভাইকে ই-মেইলে জানাচ্ছিলাম কেমন হলো ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’। কিন্তু হক ভাই বলে বসলেন, ‘তুমি নিজে দেখে আমাকে রিয়েল রিপোর্টটা জানাবে নূনা।’ এমনিতেই নাটক দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। তারপর হক ভাইয়ের এই আদেশ শোনার পর মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমাকে খুব শ্রীঘ্রই নাটকটি দেখে হক ভাইকে রিপোর্ট জানাতে হবে। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম পরবর্তী প্রদর্শনী ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতা একাডেমি মঞ্চে। ব্যাস, আর পায় কে আমাকে। সঙ্গী হলো অনন্ত হিরা, প্রকৃতি আর রামিজ রাজু। ইতোমধ্যে হক ভাইও দেশে ফিরে এসেছেন। ওপার বাংলায় যারা আমার পরিচিত তাদের প্রায় সবাইকে আমন্ত্রণ জানালাম নাটকটি দেখার জন্য। অনেকেই আসলেন, দেখলেন এবং ভূয়সী প্রশংসা করলেন। প্রশংসাযোগ্য প্রযোজনাই বটে। নাটক দেখে কলকাতা থেকে ফিরে এসে ভাবিকে (সৈয়দ আনোয়ারা হক) ফোন করে বললাম। ভাবি নাটক দেখে এসেছি। হক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করব। ভাবি বললেন। ‘চলে এসো নূনা। তোমার হক ভাই তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।’ গেলাম ২৩ সেপ্টেম্বর হক ভাইয়ের কাছে। হক ভাইকে দেখা মাত্রই বুকটা কেমন করে উঠল। যাবার আগে (১২ সেপ্টেম্বর) হক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন হক ভাইকে অনেক ফ্রেশ লেগেছিল। আজ এতো ম্রিয়মাণ লাগছে কেন! ঢুকতেই ইশারায় কাছে ডেকে বসালেন। তারপর বললেন- ‘তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ আমি এক এক করে সব রিপোর্ট দিলাম। শুনলেন, চোখ দুটো তখন চকচক করছিল তাঁর। বললাম, হক ভাই, ২০১৭-এর ১৯ মার্চ আমাদের প্রাঙ্গণেমোরের নাট্যোৎসবে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ হবে। তখন আপনি দেখবেন। হক ভাই বললেন, ‘১৭ মার্চ কর, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে।’ বললাম তাই হবে হক ভাই। আরও জানালাম যে ওপার বাংলায় একজন আপনার ‘ঈর্ষা’ নাটকটি ফিল্ম করার কথা ভাবছেন। তারপর হক ভাই আমাকে যা বললেন তা আমি এখনও সত্যি বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি হক ভাই এ কথা আমাকে বলেছেন!! হক ভাই বললেন- ‘আমার নাটক কে কিভাবে করছে তুমি একটু দেখ নূনা। এ দায়িত্ব তোমার।’ আমি দেখব হক ভাই...। প্রথম যেদিন হাসপাতালে হক ভাইকে দেখতে গেলাম সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন। কোনটা রেখে কোনটা বলব। আমি থিয়েটারের মানুষ বলেই হয়তো তাঁর একটা কথা অন্তরে চিরগাঁথা হয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘থিয়েটারে মিথ্যে বাক্য উচ্চারিত হয় না। সর্বকালে পৃথিবীর সব মঞ্চে সত্য উচ্চারিত হয়। একদল জীবন্ত মানুষ অভিনয় করে আরেক দল জীবন্ত মানুষ তা দেখে। এই দু’পক্ষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সব মিথ্যা, সব অসত্য পুড়ে যায়, ভষ্ম হয়ে যায়।’ আরও এমন বাঁধিয়ে রাখবার মতো অসংখ্য কথা। আমার খুব লোভ হচ্ছিল। সারাদিন তো কত ভিজিটরই হক ভাইকে দেখতে আসেন এবং হক ভাই তাদের অনেকের সঙ্গে এমন দু-চারটে কথা নিশ্চয়ই বলেন। ইস, আমি যদি হক ভাইয়ের পায়ের কাছে বসে থাকতে পারতাম আর সারাদিন হক ভাই যাকে যা যা বলেন, তা বসে বসে নোট করতে পারতাম! তাহলে হয়তো কত অসাধারণ কথা পেয়ে যেতাম আমরা। দ্বিতীয় দিন যখন দেখতে গেলাম, হক ভাইয়ের কণ্ঠটা তখন অনেক দুর্বল লাগছিল... শরীরেও হয়তো অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রায় এক ঘণ্টা ছিলাম। চলে আসার সময় বললেন, ‘আবার উঠব, দাঁড়াব, নাচব।’ কী দৃঢ় প্রত্যয় তাঁর চোখে-মুখে! কিন্তু হক ভাই, ভাবতেই পারছি না আপনি আর জিন্সের প্যান্ট আর মেরুন কালারের শার্ট পরে পকেটে হাত দিয়ে নায়কোচিতভাবে হেঁটে এসে ভাবিসহ শিল্পকলায় প্রথম সারিতে বসে আমাদের নাটক দেখবেন না!! আপনার কথাই আজ আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে- ‘হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।’ আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মর্মে- আমাদের কর্মে, যেমন আছেন রবীন্দ্রনাথ।
×