
জলবায়ু পরিবর্তনের ধকল সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততার বৃদ্ধি, সুপেয় পানির সংকট—সব মিলিয়ে এখানকার মানুষের টিকে থাকার লড়াই প্রতিনিয়ত কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত এবং আলোচনার বাইরে থাকা বিষয়গুলোর একটি হলো কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্য। সচেতনতার অভাব, সামাজিক ট্যাবু, আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে এখানকার কিশোরীরা মাসিক চলাকালে নানামুখী সংকটে পড়ে। অনেকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারে না, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ নেই, আবার কেউ কেউ স্কুলে যাওয়া থেকেও বিরত থাকে। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার বা নিরাপদ পানির ব্যবস্থা।
এই চিত্র পাল্টাতে ২০২৪ সালে শুরু হয় ‘সাইকেল অফ স্ট্রেংথ’ প্রকল্প, যার নেতৃত্বে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের তরুণ ফেলো মেহেরাব হোসেন। প্রকল্পের শুরুতে কয়রার কিশোরীদের মধ্যে একটি গবেষণা চালানো হয়, যেখানে দেখা যায়, অধিকাংশ মেয়ে প্রথম মাসিকের আগে কোনো প্রস্তুতি পায়নি। তাদের মা কিংবা পরিবারের বড়রা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি, ফলে প্রথম অভিজ্ঞতা হয় ভয়, আতঙ্ক আর ভুল ধারণায় ভরা। কেউ মনে করে, মাসিকের সময় রান্নাঘরে যাওয়া নিষেধ; কেউ ভাবে, এই সময়ে শরীর অপবিত্র হয়ে যায়; আবার কেউ বিশ্বাস করে, বেশি নড়াচড়া করলে রক্তপাত বেড়ে যাবে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, লবণাক্ত পানি ব্যবহারে এখানকার কিশোরীরা বিভিন্ন সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, যা ভবিষ্যতে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রকল্পে যুক্ত হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা—আশা আক্তার সুমি, তামিমা স্বর্ণা, প্রতিজ্ঞা কারকি, রিফা তাসনিম, নিশাত জামান অর্নি, মালিহা আনজুম, রাবেয়া বশরি আঁখি, অজয় মজুমদার ও খন্দকার সাইফ হোসেন— কয়রার কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রথমে কয়রা সুন্দরবন মডেল গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা নিজেদের জ্ঞান সহপাঠীদেরও শেখাতে পারে। এই “সহপাঠী-থেকে-সহপাঠী” পদ্ধতির মাধ্যমে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের পরিবার ও স্থানীয় সমাজেও।
প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে কিশোরীদের শেখানো হয়, কীভাবে নিরাপদ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়, ব্যবহৃত উপকরণ কীভাবে নিরাপদভাবে ফেলতে হয়, এবং মাসিককালীন শারীরিক অস্বস্তি দূর করতে কী ধরনের ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। প্রতিজ্ঞা কারকি মাসিককালীন ব্যথা কমানোর জন্য যোগব্যায়াম শেখান। শুরুতে এটি নতুন অভিজ্ঞতা হলেও অংশগ্রহণকারীরা দ্রুত তা রপ্ত করে এবং নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে শুরু করে।
তবে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা শুধু কিশোরীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে পরিবর্তন সম্ভব নয়; বরং পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। প্রকল্পের একটি বড় অর্জন হলো—যখন কিশোরীরা তাদের মায়ের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে শুরু করে, তখন মায়েরাও বুঝতে পারেন, এটি লজ্জার বিষয় নয়, বরং তাদের কন্যাদের সহায়তা করা উচিত। ধীরে ধীরে স্কুল কর্তৃপক্ষও উপলব্ধি করে, মাসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৌচাগার ও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।
প্রকল্পের অন্যতম সাফল্য হলো এর টেকসই প্রভাব। এটি একটি স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগে সীমাবদ্ধ না থেকে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। ৩০০ কিশোরী সরাসরি প্রশিক্ষণ পেলেও “সহপাঠী-থেকে-সহপাঠী” শিক্ষার মাধ্যমে এই সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়ভাবে একটি গাইডবুক তৈরি করা হয়, যাতে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০২৫ সালের মার্চে আয়োজিত চূড়ান্ত উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে কিশোরীরা তাদের অভিজ্ঞতা ও বদলে যাওয়ার গল্প শেয়ার করে। তারা জানায়, কীভাবে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হওয়া তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং কীভাবে তারা ভয় ও লজ্জার গণ্ডি পেরিয়ে নিজেদের জীবন ও সিদ্ধান্তের নিয়ন্ত্রণ নিতে শিখেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তুলে ধরেন আকলিমা সুলতানা, ৯ম শ্রেণির ছাত্রী, কয়রা সুন্দরবন মডেল গার্লস স্কুল।
তিনি বলেন, “দুর্যোগকালীন সময়ে মাসিক চলাকালীন আমাদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সবাইকে যখন সাইক্লোন সেন্টারে যেতে বলা হয়, সেখানে খাবার-দাবারসহ অনেক কিছুর ব্যবস্থা থাকলেও পিরিয়ডের জন্য কোনো আলাদা ব্যবস্থা থাকে না। এছাড়াও বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের সময় ঘরে পানি উঠলে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ি। এখন আমরা শিখেছি মাসিক চলাকালীন কিভাবে চলতে হয় এবং সুষম খাবার—যেমন মাছ, মাংস, সবুজ শাকসবজি—গ্রহণ করতে হয়।”
একই শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা আক্তার বলেন, “উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় আমাদের অনেক বিষয় অজানা ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিখেছি, পিরিয়ডকালীন সময়ে কীভাবে নিজের শরীরের যত্ন নিতে হয়। সুষম খাদ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা এখন দুর্যোগকালীন সময়েও নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে পারি।”
প্রকল্প সফলতা সম্পর্কে মেহেরাব হোসেন বলেন, “কয়রায় দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কিশোরীরা কীভাবে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে লজ্জা, ভয় আর ভুল ধারণার বেড়াজালে আটকে আছে। সমাজের নীরবতা তাদেরও চুপ থাকতে শিখিয়েছে। কিন্তু এবার তারা প্রশ্ন করছে, শিখছে, জানছে—নিজেদের অধিকার বুঝতে পারছে। এটাই প্রকৃত পরিবর্তনের সূচনা। আমি ও আমার টিম আরও বিস্তৃত পরিসরে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে এই পরিবর্তনকে এগিয়ে নিতে চাই।”
এই প্রকল্পটি দেখিয়েছে, সত্যিকারের পরিবর্তন আসে নেতৃত্বের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগ কয়রার কিশোরীদের জন্য নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি প্রমাণ করেছে—মাসিক লজ্জার নয়, বরং স্বাভাবিক ও শক্তির প্রতীক। ‘সাইকেল অফ স্ট্রেংথ’ আমাদের শিখিয়েছে, পরিবর্তনের প্রথম ধাপ সচেতনতা, আর নেতৃত্বের ক্ষমতা আমাদের নিজেদের হাতেই।
সজিব