বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ ঠেকাতে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমাতে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রবিবার এ সুদের হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে ঠিক কবে থেকে এবং কোন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কতটা কমানো হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট করে তিনি কিছু বলেননি।
রবিবার বিকেলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ‘আমাদের সঞ্চয়পত্রগুলোর সুদের হার খুবই বেশি। এটা চলতে থাকলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বেড়ে যাবে। সরকারের ভবিষ্যত ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। সে কারণেই আমরা এটাকে কমানোর (রিভিউ) সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এর আগে আমরা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়িয়েছিলাম। সেটা আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’
এর আগে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর সঞ্চয়পত্রের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘সুদের হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। বিক্রি বাড়ায় চলতি বাজেটে এ খাত থেকে সরকার ঋণ নেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) তার দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নেয়া হয়ে গেছে। এমনটা হতে থাকলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা সমস্যার মধ্যে পড়বে।’
ব্যাংক আমানতের তুলনায় সুদ বেশি দেয়া এবং পুঁজিবাজারে পড়তিভাবে অনেকেই ঝুঁকে পড়েন নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে। সম্প্রতি ব্যাংকের সুদহার আরও কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির পালেও হাওয়া লাগে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট ২৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের আসল-সুদ বাবদ ৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। ফলে সঞ্চয়কারীদের নিট বিনিয়োগ অর্থাৎ সরকারের এ খাতে ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০০ শতাংশ বেশি।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৯ হাজার ৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে। তবে আট মাসেই তার দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নেয়া হয়ে গেছে। আর এই ঋণের ভার নিয়ে বিচলিত সরকার, যা স্পষ্ট হয়ে উঠে বিভিন্ন সময়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথায়। তিনি বলেছেন, ‘বাজারে বিদ্যমান অন্যান্য সঞ্চয় উপকরণগুলোর চেয়ে তুলনামূলক আকর্ষণীয় সুদের হার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়াচ্ছে, যা সরকারের সুদ ব্যয় ভবিষ্যতে বাড়াতে পারে।’
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিদেশী উৎসের পাশাপাশি দেশীয় উৎস থেকেও ঋণের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ব্যাংক এবং ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে এ ঋণ নেয়া হয়। ব্যাংক বহির্ভূত উৎসের বেশিরভাগ ঋণই সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হয়। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। এবার ব্যাংক খাত থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করেছে তার তুলনায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বেশি। সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি ছিল ১৪ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এবার একই সময়ে মোট বিক্রি তার চেয়েও ১১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা বেশি হয়েছে।
একক মাস হিসেবে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে এক হাজার ৪৪ কোটি টাকার সুদ-আসল পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা বিক্রি থেকে ৯৯১ কোটি টাকার আসল-সুদ পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। এ হিসেবে একক মাস হিসেবেও গত ফেব্রুয়ারিতে নিট বিক্রি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। জানুয়ারি মাসেও নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
এভাবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়তে থাকলে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা চাপের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদের হার কম এবং শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দার কারণে সবাই নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু এর বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছে সরকার।
‘সোস্যাল সেফটিনেটের (সামাজিক নিরাপত্তা) বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকার এর সুদের হার কমাতে পারছে না। অন্যদিকে বেশি লাভের আশায় সবাই এ খাতে বিনিয়োগ করায় সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে।’ ভবিষ্যত ঋণের বোঝা কমাতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হতে পারেÑ এ ধারণা থেকেও অনেকে আগেভাগেই এ খাতে টাকা লগ্নি করছেন বলে মনে করছেন জায়েদ বখত।
২০১৪ সালের শেষের দিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো নিয়ে আলোচনা উঠেছিল। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি দাবি তুললেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকগুলো মেয়াদী আমানতে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দিলেও এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ১ মার্চ থেকে সরকারী ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে মেয়াদী আমানত নিচ্ছে। অন্যদিকে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদ বা মুনাফা হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ ও তিন বছর মেয়াদী তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। আর তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয় ও ব্যাংক মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। আট মাসে এর নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বিক্রির শীর্ষে থাকা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৯৭০ কোটি, পোস্ট অফিসের মেয়াদী সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৪০৪ কোটি এবং ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ২৫৯ কোটি টাকা।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: