ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সমরাস্ত্র প্রদর্শনী ঘিরে কৌতূহল তুঙ্গে

সত্যিকারের ট্যাঙ্ক যুদ্ধবিমানে চড়ার বিরল সুযোগ

মোরসালিন মিজান 

প্রকাশিত: ০০:১২, ২৮ মার্চ ২০২৪

সত্যিকারের ট্যাঙ্ক যুদ্ধবিমানে চড়ার বিরল সুযোগ

পিলে চমকে যাওয়ার মতো সমরাস্ত্র। তা-ই নিয়ে দিব্যি খেলায় মেতেছে এক শিশু।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসার সময় সবুজ গাছগাছালি আর মৌসুমি ফুলের বাগানই বেশি চোখে পড়ে। বাস্তবে ক্যান্টনমেন্ট অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ যুদ্ধযান ইত্যাদিতে ঠাসা। বহিশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষা এবং সর্বাবস্থায় সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজনেই সমরাস্ত্রের বিশাল এই ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের এসব নিয়ে কৌতূহল আছে বটে, দেখার সুযোগ পান না।

তবে বর্তমানে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দর এলাকায় চলছে সপ্তাহব্যাপী সমরাস্ত্র প্রদর্শনী। সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনীর যৌথ আয়োজন গত ২৪ মার্চ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৬ মার্চ সবার জন্য প্রদর্শনী উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই সেখানে কৌতূহলী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। প্রদর্শনীতে সচল ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ, ¯œাইপার রাইফেল, পিস্তল, কামানের গোলা, মিসাইল, রকেট লাঞ্চার, ড্রোনÑ আরও কত কী! দেখে শেষ করা যায় না। কোনো কোনো সমরাস্ত্র দেখে বড়দের পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা হয়। কিন্তু শিশুরা বেজায় খুশি। দিব্যি খেলছে তারা। 
বুধবার দুপুরের দিকে প্রদর্শনী এলাকায় প্রবেশ করে রীতিমতো ধাক্কা খেতে হলো। প্রথমে মনেই হয়নি এত বড় আয়োজন। ক্রমে বিস্ময়ভরা চোখে সেটি আবিষ্কার করতে হয়েছে। লম্বা রানওয়ের সমান্তরালে মূল প্রদর্শনী। উন্মুক্ত স্থান এবং প্যাভিলিয়নে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। 
সহসাই দৃষ্টি কাড়ে পেট মোটা আর লম্বা নাসিকাযুক্ত ট্যাঙ্ক। অর্ধডজন ট্যাঙ্ক পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কী কা-! সেনাবাহিনীর সচল ট্যাঙ্কে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে পড়ছিল শিশুরা। কেউ থামাচ্ছিল না তাদের। বড়রাও বড় বড় চোখ করে ট্যাঙ্কের ভেতর বাহির দেখছিলেন। পাহারায় থাকা একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ট্যাঙ্কগুলোর মধ্যে ভিটি- ফাইভ সবচেয়ে আধুনিক। এটি ১০৫ মি.মি. মেইনগান, ১২.৭ মি.মি. মেশিনগান, ৪০ মি.মি. অটোমেটিক গ্রেনেড লঞ্চার সমৃদ্ধ। ট্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য ৯.২৫ মিটার। উচ্চতা ২.৫০ মিটার। ওজন ৩৩ হাজার থেকে ৩৬ হাজার কেজি। সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটার।   
বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টারগুলোও দর্শনার্থীদের খুব আকর্ষণ করছে। বিমানের ভেতরে প্রবেশ করতে কোনো বাধা নেই। বাবা-মায়েরা শিশু সন্তানকে ‘ফাইভ থ্রি জিরো সেভেন’ বিমানের  পাইলটের আসনে বসিয়ে দিয়ে ছবি তুলছিলেন। 
বিমান বাহিনীর সাম্প্রতিক সাফল্যের বড় উদাহরণ হয়ে প্রদর্শনীতে আছে দুটি প্রশিক্ষণ বিমান। বঙ্গবন্ধু বেসিক ট্রেইনার ওয়ান এবং বঙ্গবন্ধু বেসিক ট্রেইনার টু উদ্ভাবন করে চমক সৃষ্টি করেছে বিমান বাহিনী। এ বিমান দুটি দেখতেও ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা। 
নৌবাহিনীর প্রদর্শনীতে বাড়তি আকর্ষণ হয়ে এসেছে একটি যুদ্ধজাহাজ। ‘বা নৌ জা বঙ্গবন্ধু’র আদলে এটি তৈরি করা হয়েছে। কাঠামোটি এত রিয়ালিস্টিক যে, দূর থেকে সত্যি সত্যি জাহাজ বলে মনে হয়। এর ভেতর দিয়ে সামনে এগোলে খোলা উদ্যান। সেখানে জাহাজ থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য গোলা, সি এইট জিরো আলফা মিসাইল, ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি রকেট লঞ্চার, ডিফেন্ডার ক্লাস বোট, ড্যানবয় ইদ্যাদি প্রদর্শন করা হচ্ছে। প্রদর্শনীতে রাখা দুটি ড্রোন, কথা বলে জানা গেল, নৌবাহিনীর নিজের তৈরি। ২০১৩ সাল থেকে তারা এই সংক্রান্ত গবেষণায় আছেন। তাদের সাফল্যের কথা তুলে ধরছে ড্রিম থ্রি ও ড্রিম ফোর ড্রোন।  
সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে যোগ হয়েছে ইতিহাসের উপাদানও। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র এখানে প্রদর্শন করা হচ্ছে। দেখে কী যে গর্ব হয়! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি নিদর্শন দিয়ে সাজানো একটি প্যাভিলিয়নে গিয়ে ২২টির মতো অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবগুলোই মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়েছে। এসএমজি, অটোরাইফেল, সেমি অটো রাইফেল, এমএমজি থ্রি রাইফেল, ¯œাইপার রাইফেল, ১২ বোর শটগান, রকেট লঞ্চার, নাইন এমএম স্টেন, মর্টার এখন অচল। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি সাহস ও দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে আছে।   
বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার প্যাভিলিয়নেও রাখা আছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করা অস্ত্র। এখানে প্রায় এক ডজন অস্ত্র। অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন মিমি স্টালিং সাব মেশিনগান, ৭.৬২ মি.মি. সেল্ফ লোডিং রাইফেল, এমজি ফোরটি টু, ৭.৬২ মিমি এলএমজি। এ অস্ত্রগুলো দেখতে দেখতেও গৌরবোজ্জ্বল অতীতে চলে যাওয়া যায়। 
প্রদর্শনীর আরেকটি বৈশিষ্ট্যÑ এর সঙ্গে দর্শনার্থীরা খুব সহজে একাত্ম হতে পারছেন।

অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য দেওয়া হচ্ছে কৌতূহলীদের। কিছু সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্যারা কমান্ড ব্রিগেড দিচ্ছে হেলিকপ্টার থেকে প্যারাসুট বেয়ে নামার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। রেফলিং করতে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন দর্শনার্থীরা। আরও নানাভাবে প্রদর্শনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন আয়োজকরা। 
সব মিলিয়ে অনন্য সাধারণ একটি আয়োজন। চলবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত। তবে এই প্রদর্শনীর সময় বাড়ানোর জন্য বহু মানুষ দাবি জানিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ শুনবে কি?

×