ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আলা উদ্দিন

পদ্মা সেতুর বহুমুখী তাৎপর্য

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২২ মে ২০২২

পদ্মা সেতুর বহুমুখী তাৎপর্য

পদ্মা সেতু একটি স্বপ্ন। একটি স্বাধীন দেশের স্বনির্ভরতার চ্যালেঞ্জ। এই সেতু নির্মাণের সময়, অর্থ, ব্যয় ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা আছে। এর অধিকাংশ যদি সত্যও হয়; এর বাস্তবায়ন তথা সেতু স্থাপন করার মাঝে সকল জল্পনা-কল্পনা, গুজব, ইত্যাদি সবটাই ম্লান। বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অবকাঠামো নির্মাণের ধারায়, বারবার সময় বৃদ্ধি ও অর্থের পরিমাণ বাড়ানো কিংবা অপচয় অনুচিত হলেও দীর্ঘদিনের প্রচলন। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ যে সাফল্যের সঙ্গে এই প্রথম এত বড় একটি কর্ম সম্পাদন করল, অন্য কোন কথা সেখানে আর গুরুত্ব পায় না। সেতু ভিন্ন বাকি সব হয়ে যায় অহেতুক। বিশালত্বের দিক থেকে অর্থায়ন ও কর্মসম্পাদন যে এককভাবে সম্পন্ন করা যায়, তা এতদিন ছিল কল্পনারও অতীত। আজ তা বর্তমান ও বাস্তবিক। এই সেতু আমাদের সেতু। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এই সেতুর মালিক। কারণ, এর অর্থায়ন করেছে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। সুতরাং এই সেতু বাস্তবায়নে সক্ষমতা এবং স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জের মধ্যকার যে মজবুত সেতুবন্ধ রচিত হয়েছে, তার গৌরব ও মালিকানা নিতান্তই দেশের মানুষের। এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের মতো প্রকা- বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে, তাদের সকল দাবিকে অগ্রাহ্য ও পরাজিত করে বাংলাদেশের মান সমুন্নত উচ্চাসীন করার অনন্য কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ এর বাস্তবতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা যেতে পারে। পদ্মা সেতু নির্মাণ কোনভাবেই একাত্তরের বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। তবে, পদ্মা সেতুর সাফল্যে একাত্তরের সফলতা স্মরণ করা অমূলকও নয়। একাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্বাধীনতার আহ্বান করেছিলেন এবং নিজের গ্রেফতার/মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় মুক্তিকামী জাতির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা রচনা করেছিলেন। তাঁর সে সময়কার প্রজ্ঞা, সাহস ও দেশমাতৃকার জন্য ভালবাসা কেবল দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রয়াসে বাঙালীর জীবনবাজি রাখা মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের মাঝেই নিহিত। ২৬ মার্চ শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালী কিভাবে যুদ্ধ করবে, কদিন টিকে থাকতে পারবে এগুলো ছিল সাধারণের ভাবনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন ঐক্যবদ্ধ বাঙালীর শক্তি। বাঙালীও তাই সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপদান করেছে। সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে যে কোন শক্তিকে যে পরাজিত করা যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বিজয় তার প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত। একুশ শতকের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পদ্মা সেতু আরেকটি দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশীরা যে নিজেরাই নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সক্ষমতা রাখে; উন্নয়ন সহযোগীরা সহযোগিতা করলে ভাল; অন্যথায়, তাদের ছাড়াও যে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য ও সক্ষমতা রাখে, তা আজ প্রমাণিত। ছোটখাটো কোন কাজের মধ্য দিয়ে নয়, প্রকা- কর্ম সম্পাদনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ তা প্রমাণ করেছে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের স্থান কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তা ভাবনারও অতীত। এখন দরকার সঠিক নেতৃত্বের সুদৃঢ় সংকল্প, যেন বিদেশ নির্ভরতা পরিত্যাগ করে বাংলাদেশে জাতির পিতার অপূর্ণ স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়ন করা। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক যখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ চুক্তি বাতিল করে, তখন দৃঢ়চিত্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের মে মাসে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। দেশবাসীও তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছে। অবশেষে সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশের মানুষ এর সুফল পেতে শুরু করবে (সম্ভবত জুন মাসেই)। এই প্রকা- সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয় অর্জন। দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পদ্মার ওপর নির্মিত ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক ও রেলসেতু দেশের প্রধানতম এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ সেতু। সেতুটির ওপরের স্তরে চার লেনের মহাসড়ক ও নিচের স্তরে একটি রেলপথ বিদ্যমান। এই সেতুটির দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বিস্ময়। আশা করা যায় পূর্ণ উদ্যমে শুরু হলে এই সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৭৫,০০০ যানবাহন চলাচল করবে। সেতুটির মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হবে এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ স্থপিত হবে। অর্থাৎ দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের সোনালি ভবিষ্যতকে দেশের অপরাপর অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জিডিপি আনুমানিক ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করবে। প্রকারান্তরে জাতীয় জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমিত। যোগাযোগ, সংযোগ ও অর্থনীতির সূচক ছাড়াও এই সেতুতে এক টাকা বিনিয়োগ থেকে দ্বিগুণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুবিধা অর্জিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সুতরাং, পদ্মা সেতুকে কেবল রড-সিমেন্টের সেতু বা এর স্থাপনাকে প্রকৌশলগত অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। বরং একে প্রযুক্তি, শিক্ষা, উন্নয়ন, ভূরাজনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রথমত, বাংলাদেশ যে কোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সক্ষমতা রাখে, এটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। একই সঙ্গে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় মনোবল, সাহসিকতা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে পূর্বের তথা প্রাচ্যের কাছে প্রতীচ্যের পূর্বতন সক্ষমতার নবতর উন্মোচন। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী গৌরবান্বিত দেশের মর্যাদাসীন দেশ। তৃতীয়ত, নিজেদের শক্তি, সক্ষমতা ও ভূগোলকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে এই বহুমুখী সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে। চতুর্থত, দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশকে বাদ বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে দেশের মধ্যকার এতদিনকার অভ্যন্তরীণ দূরত্ব লাঘব হবে। ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান তথা সকল খাতে প্রভূত গতি সঞ্চার হবে। পঞ্চমত, দেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে বিশালাকৃতির সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে এটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক ও চেতনায় পরিণত হয়েছে। ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে বলতে হয়, ‘পদ্মা আমার মা’। পদ্মা সেতু নির্মাণের সফলতা কেবল এই সেতুর সচলতার মধ্যে নির্দিষ্ট নয়। পদ্মা সেতু যেমনি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্ধনের মাধ্যমে গোটা দেশের সঙ্গে সংযোগ ও যোগাযোগ স্থাপন করবে, তেমনি যোগাযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাপর খাতসমূহের সংযোগ ও সুষম সমন্বয় অপরিহার্য। সকল খাতসমূহের মাঝে সুষম সংযোগ ও সমন্বয় সাধনপূর্বক বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত রাষ্ট্রনীতির আলোকে দেশ পরিচালিত হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা ক্রমশ অগ্রসর থাকবে। সোনার বাংলামুখীন অভিযাত্রার মাঝেই মূলত পদ্মা সেতু নির্মাণসহ সকল চ্যালেঞ্জ ও উদ্যোগের সার্থকতা নিহিত। বাংলাদেশ যখন পরাধীন তখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে স্বপ্ন দেখেছিলেন শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার, সোনার বাংলা গড়ার। কিন্তু তাঁকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে খুনীরা তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। আজও তা অপূর্ণ রয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁর স্বপ্নপূরণ সহজসাধ্য না হলেও মোটেও তা অসাধ্য নয়। পদ্মা সেতুর সফল নির্মাণে দেশের মানুষও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। কেবল পদ্মা সেতু নয়; সর্বস্তরের মানুষের জীবনের সার্বিক গতির ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমেই (শোষণহীন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক) সম্ভব বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করা। সে লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে যাক, এটাই জাতির প্রত্যাশা। লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×