ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

হাফ ভাড়া হলেও সড়ক নিরাপদ হবে কবে

প্রকাশিত: ২১:১৩, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

হাফ ভাড়া হলেও সড়ক নিরাপদ হবে কবে

শেষ পর্যন্ত হাফ ভাড়া মেনে নিতে বাধ্য হলেন বাস মালিকরা। এর আগে অনেক নাটক করলেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের আন্দোলনের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হলেন। আবারও প্রমাণিত হলো, ছাত্র আন্দোলন কখনও বৃথা যায়নি, বৃথা যেতে পারে না। এই ছাত্র আন্দোলনেরও গোড়াপত্তন করেছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ বিভাগের পর থেকেই তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন শুরু করেন। আবার তার দেখানো পথেই পরবর্তী প্রজন্মের ছাত্ররা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। আবার বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার নেতৃত্বেই এই ছাত্ররা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। তারপরও শেষ হয়ে যায়নি ছাত্র আন্দোলন। স্বাধীন বাংলাদেশে নব্বই সালে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের যে পতন ঘটেছে, সেখানেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিল মুখ্য। এরপর আমরা সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলন দেখেছিলাম এয়ারপোর্ট রোডে দুই ছাত্রের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে। সেই আন্দোলন পুরো ঢাকা শহরকে উত্তাল করে তুলেছিল। সর্বশেষ দেখলাম, অর্ধেক তথা হাফ ভাড়ার দাবি আদায়ে ছাত্রদের আন্দোলন। এই আন্দোলন আরও গতি পায় নটরডেম কলেজের এক ছাত্রের দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। ওই ছাত্রের মৃত্যুর পর ছাত্র আন্দোলন আর অর্ধেক ভাড়ার মধ্যে সীমিত থাকেনি, নিরাপদ সড়কের দাবিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের মধ্যেই রামপুরায় বাস চাপায় এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে ছাত্র আন্দোলন চললেও বাস মালিকরা এ দাবি না মানার ব্যাপারে বরাবরই অনড় থাকেন। সরকারের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক ব্যর্থ হযে যায় তাদের অনড় অবস্থানে। ফলে প্রথমে যেমন সচিবদের সঙ্গে বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়, তেমনি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সঙ্গে বৈঠকও ব্যর্থ হয়ে যায় মালিক পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে। এরই মধ্যে সরকার বিআরটিসি বাসে ১ ডিসেম্বর থেকে ছাত্রদের অর্ধেক ভাড়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস মালিকরা যেমন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর সরকারের কাছ থেকে বাস ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আদায় করে নিয়েছে, তারা ভেবেছে এবারও অর্ধেক ভাড়ার নামে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি আদায় করে নেবে। এজন্য তারা নানা টালবাহানা করে পর পর দুটি বৈঠক ব্যর্থ করে দেয়। উল্টো ইস্যুটিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য কিভাবে হাফ ভাড়া বাস্তবায়ন হবে, সেটি নির্ধারণে টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেয়। এছাড়াও বিআরটিএর সঙ্গে আলোচনায় তারা ১১টি মতামত দেয়, এর সবই তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। নগর পরিবহনে হাফ ভাড়া ছাত্রদের একটি অধিকার। এই সুবিধা ছাত্ররা যুগের পর যুগ ধরে পেয়ে আসছে। এখন সব কিছুতেই কর্পোরেট কালচার চালুর একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কর্পোরেট ব্যবস্থা চালুর নামে বাসের গায়ে লিখে দিচ্ছেন ‘হাফ ভাড়া নাই’। সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিল নাম দিয়ে তারা বেশি ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিলের মাধ্যমে ৬ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ১০ টাকা। ১০ টাকার ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা। সরকারের নাকের ডগা দিয়ে বাস মালিকরা এসব করে যাচ্ছে, অথচ সরকার নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে, নগর পরিবহন দেখার মতো দেশে কোন মন্ত্রণালয় নেই। বিআরটিএ বাস ভাড়া বৃদ্ধি বা মাঝেমধ্যে মোবাইল কোর্ট বসানো ছাড়া তাদের আর কোন কাজ নেই। বাব-মা বিহীন সন্তান যেমন ছন্নছাড়া ও বিশৃঙ্খল থাকে, দেশের পরিবহন খাতও ঠিক তেমনি অবস্থায় চলছে। বিশ্বের কোথাও এমন নগর পরিবহন ব্যবস্থা নেই। আমরা উন্নয়নশীল দেশের পথে যাচ্ছি, দেশের উন্নয়ন নিয়ে আমরা গর্ব করছি, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা ও ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা উঠলেই এগুলো অনুপস্থিত। এখনও সেই মান্ধাতা আমলের এ্যানালক সিস্টেমে চলছে গণপরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থা। অথচ ভাড়া কিন্তু উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, দেশের মানুষ এবং সরকার পরিবহন মালিকদের কাছে যেন জিম্মি। আর দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা জিম্মি ট্রাফিক পুলিশের কাছে। তাদের অনমনীয় মনোভাবের কারণেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে ট্রাফিক সিগনালিং ব্যবস্থা উন্নয়নের পরও এখনও হাত দিয়েই চলছে দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, সিটিং সার্ভিস, বিরতিহীন ইত্যাদি নাম দিয়ে বিভিন্ন রুটে বাস সার্ভিস চালু করেছে বাস মালিকরা। সেখানে হাফ ভাড়ার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে। হালে সিটিং সার্ভিস, বিরতিহীনের নতুন সংস্করণ হচ্ছে ওয়েবিল। ভাড়া বৃদ্ধি কার্যকর করার পর এই ওয়েবিল বা সিটিং সার্ভিস তুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগুলো অব্যাহত আছে। আগেই বলেছি, পরিবহন খাত হচ্ছে বাপ-মা বিহীন। ফলে এগুলো দেখার কেউ নেই। বাস মালিকরা শর্ত সাপেক্ষে এই হাফ ভাড়া ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করেছে। পরিবহন মালিকদের শর্তের সঙ্গে আমরা একমত। কোন ছাত্রের হাফ ভাড়ার সুবিধা পেতে হলে তাকে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং তার আইডি কার্ড থাকতে হবে। রাত ৮টার পর এই হাফ ভাড়া কার্যকর হবে না। এটাও যুক্তিসঙ্গত। যদিও কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ইভিনিং’ পড়াশোনা হয়। তারপরও এই শর্ত মেনে নেয়া যায়। ছুটির দিনে হাফভাড়া কার্যকর হবে না। সেটাও মেনে নেয়া যায়। কারণ শুধু একপক্ষের বিষয়টি দেখলে হবে না। উভয় পক্ষের লাভালাভের বিষয়টিও ভাবতে হবে। তবে এই হাফ ভাড়া শুধু ঢাকা শহরে কার্যকর হবে- মালিকদের এই শর্ত মানতে পারছি না। সারাদেশের জেলা এবং উপজেলা শহরগুলোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। তারাও তো ছাত্র। গরিব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাদের প্রতি বৈষম্য করা হবে কেন? ঢাকা শহরের মতো জেলা এবং উপজেলা শহরগুলোতেও হাফ ভাড়া কার্যকর করা আবশ্যক। ছাত্ররা এখন সেই দাবি-ই তুলছে। ঘোষণা না দেয়া হলেও জেলা উপজেলা পর্যায়ের পরিবহন মালিকরা এই বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখবেন বলেই আশা করছি। অন্যথায় জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই আন্দোলন ছাড়িয়ে পড়তে পারে। মনে রাখবেন, প্রত্যেক ব্যবসায়ীরই এই দেশের প্রতি একটি দায়বদ্ধতা আছে। আপনি এই দেশে ব্যবসা করবেন, মানুষের গলা কেটে মুনাফা পকেটে ভরবেন, কিন্তু এই দেশ ও সমাজকে আপনি কিছু দেবেন না- এটা হতে পারে না। কর্পোরেট কালচারে ‘স্যোসাল রেসপনসিবিলিটি’ বা সামাজিক দায়াবদ্ধতা বলতে একটি কথা আছে। যাকে সংক্ষেপে সিএসআর বলা হয়। বিশ্বের সব সভ্য দেশেই এই ব্যবস্থা কার্যকর। আমাদের দেশেও এখন সরকারী-বেসরকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো এই চর্চা শুরু করেছে। এটি আয়কর এবং জাকাতের বাইরে। এই সিএসআর খাতে অর্থ ব্যয় করলে সরকার সে জন্য আয়করে রিবেট দিয়ে থাকে। পরিবহন মালিকরা যে এই হাফ ভাড়া কার্যকর করেছেন, সিটি তাদের একটি সিএসআর। সমাজ আশা করেছিল, এটি তারা স্বেচ্ছায় দেবেন। আগামী প্রজন্মকে সুন্দরভাবে লেখাপড়া শিখে বেড়ে ওঠার জন্য নিজেদের ইচ্ছাতেই হাফ ভাড়ার ঘোষণা দিয়ে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো যে, ছাত্রদের সেটি আন্দোলন করে আদায় করে নিতে হয়েছে। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে হতাশ করেছে, ছাত্রদের এমন একটি যৌক্তিক আন্দোলনে সরকারী দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিষ্ক্রিয়তা। দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পূর্বভাগেই ছিল ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগের এই জীর্ণ দশায় আমরা হতাশ। উল্টো, ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কিছু দাঙ্গাবাজ পরিবহন মালিকদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এটি আমাদের মর্মাহত করেছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ থেকে এটি অস্বীকার করে তারা বলেছে, এই ছাত্র আন্দোলনকে তারা সমর্থন করে। কিন্তু মাঠে তাদের সমর্থনের নমুনা দেখা যায়নি। এই আন্দোলন তো সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন ছিল না। তাহলে ছাত্রলীগ নিষ্ক্রিয় ছিল কেন? ছাত্রলীগ এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকলে হাফ ভাড়ার অর্জনের ভাগীদার তারাও হতে পারত। সবশেষে প্রশ্ন, অর্ধেক ভাড়ার দাবি তো আদায় হলো এখন সড়ক নিরাপদ করবে কে? এজন্য কী ছাত্রদের আরও আন্দোলন করতে হবে। ২০১৮ সালে ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাস বিমানবন্দর সড়কের জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের গোড়ায় ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই দু’জন নিহত হয়। আহত হয় আরও ১০-১২ জন। ওই ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা টানা তিন দিন ধরে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলন করেছে। পরবর্তীতে সরকারের নিরাপদ সড়কের আশ্বাসে ছাত্ররা ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু সেই সড়ক কি নিরাপদ হয়েছে? সড়ক নিরাপদ কে করবে? এই দায়িত্ব কার? কেউ এ ব্যাপারে কোন টুঁশব্দটি করছে না। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ সংশোধন করা হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি পরিবহন মালিকদের কারণে। সড়ক নিরাপদ করতে না পারার পেছনে সরকারেরই প্রভাবশালী একটি মহল কাজ করছে বলে ধারণা। ওই মহলটির প্রশ্রয়েই বাস মালিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে কোনভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। এভাবে চলবে আর কতদিন? ব্যক্তি স্বার্থের কাছে আর কতদিন জিম্মি থাকবে দেশবাসী আর কত প্রাণ ঝড়বে সড়কে? এর উত্তর দেয়ার কেউ নেই। দুর্ভাগ্য দেশের মানুষের। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোন কিছুতেই শৃঙ্খলা আনা গেল না। একের পর এক আইন হচ্ছে আইন অমান্যের জন্য। দেশের উন্নতি হচ্ছে, অগ্রগতি হচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক হচ্ছে, রাজপথে নামছে আধুনিক গণপরিবহন। কিন্তু সড়ক অনিরাপদই থেকে যাচ্ছে। ১.১২.২০২১ লেখক : সাংবাদিক
×