ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মন খারাপ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ৩০ নভেম্বর ২০২১

মন খারাপ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

মাইন্ড এন্ড বডি । মন এবং শরীর । দুটি কি দুই সত্তা, নাকি একই সত্তার দুই রূপ । মন কি শরীরের অংশ, নাকি আলাদা একটি অংশ । শরীর মনকে প্রভাবিত করে, নাকি মন শরীরকে প্রভাবিত করে । শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার কোন একটি অংশই কি মন, নাকি মনের ক্রিয়া কলাপের উপর নির্ভর করে শরীরের অনেক কিছু । মন শরীরের এই দ্বন্দ্ব চিকিৎসা বিজ্ঞানের অতি পুরনো একটি সমস্যা । মানসিক বিভিন্ন সমস্যা শরীরকে কতটুকু প্রভাবিত করে । বিশেষ করে ডিপ্রেশন কিংবা বিষণ্ণতা শরীরের উপর কি ছাপ ফেলে । একটু বিশদ প্রশ্ন তুললে ডিপ্রেশনের সাথে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কোন সম্পর্ক আছে কি ! কারণ দেখা গেছে যে - ডিপ্রেশনে থাকে শরীরে জীবাণুর আক্রমণ ক্ষমতা বেড়ে যায় । শরীরে ইনফ্লেমেশন এবং ইনফেকশন দেখা দেয় । শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বলে ইমিউনিটি । বাহির থেকে কোন আক্রমণ অথবা শরীরের ভেতরে কোন পরিবর্তন হলে এই ক্ষমতা শরীরকে রক্ষা করে । কিন্তু এই ক্ষমতা শারীরিক, তাহলে ডিপ্রেশনের মতো মানসিক সমস্যা কি করে ইমিউনিটির মতো শারীরিক ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে ? মন হল কতগুলো অনুভব, চিন্তা এবং বিশ্বাসের সমষ্টি । ডিপ্রেশন হল মনের কিছু অনুভূতির কমতি, অস্বস্তি এবং আকর্ষণের অভাব । কোন কিছুর প্রতি আকর্ষণ হল মনের শক্তি । শরীরকে কোন কিছু বাহির থেকে আক্রমণ করলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার নাম ইমিউনিটি । এই প্রতিরক্ষা কতগুলো রাসায়নিক উপাদান এবং কোষের সমন্বয়ে তৈরি । ডিপ্রেশন মানসিক সমস্যা, ইমিউনিটি শারীরিক ক্ষমতা । তাহলে কি করে মানসিক ক্ষমতা কমে যাওয়া শারীরিক ক্ষমতাকেও কমিয়ে দেয় ? এই কানেকশনটি বুঝতে বিভিন্ন বিজ্ঞানী দল বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছে । দুটি দলের গবেষণা এ ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য । একটি জেনেটিক লেভেল, আরেকটি মলিকুলর লেভেল । দল দুটি দু ভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে ডিপ্রেশনে ইমিউনিটি কমে যাওয়ার পার্টিসিপেন্ট দের মাঝে বায়োলজিক্যালই জেনেটিক লেভেল এবং মলিকুলর লেভেলে কিছু পরিবর্তন এসেছে । নরমাল অবস্থার সাথে এই পরিবর্তনকে তুলনা করতে গিয়ে এমনটি খুঁজে পেয়েছে । মলিকুলর লেভেলে বিজ্ঞানী দল দেখতে পেয়েছে যে ওখ-১৭ নামের একধরনের ইমিউন মলিকিউল এর জন্যে দায়ী । মন খারাপ, ডিপ্রেসেড কিংবা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হলে এই মলিকিউল পরিবর্তন হয়, যা ইমিউনিটি সিস্টেমের সাথে জড়িত এবং ইমিউনিটিকেও আক্রান্ত করে । এই ইমিউনিটি মলিকিউল ওখ ১৭ একদিকে যেমন ইমিউনিটির সাথে জড়িত, একইভাবে মস্তিষ্কের নিউরনের উপরও তার প্রভাব আছে। ওখ ১৭ একধরনের সাইটকিন । এটি ইমমিউনিটির অংশ । কোন কারণে ইনফেকশন বেড়ে গেলে এই ধরনের সাইটোকিন ওভার রিয়েক্টেড করে শরীরে । হাইপোথিসিস যে ওখ১৭ এবং নিউরনের মধ্যে মস্তিষ্কে একটি ওভার স্টিমুলেশোন কানেকশন তৈরি হয় । একদিকে এটি বেড়ে গেলে মস্তিষ্কে. তার প্রভাবে ডিপ্রেশন দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, আবার ডিপ্রেশন বেড়ে গেলে ওখ ১৭ বেড়ে যায় । তার মানে মানসিক ভারসাম্যহীনতা এই মলিকিউলটিরও ভারসাম্যহীনতা আনে । আবার একই মলিকিউলটি ইমিউনিটির রেসপন্সে একটিভেট হয়ে কাজ শুরু করে । ক্রমাগত ডিপ্রেসেড থাকলে ওখ ১৭ বেড়ে গিয়ে ইনফ্লয়েমেট্রি রেসপন্স বেশি দেখা দিতে থাকে, শরীরে ইনফেকশন বেড়ে যায় । গবেষণাটি থেকে বিজ্ঞানী দলের অভিমত যে, আমাদের মনের গতি অনেকাংশে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার গতির উপর নির্ভর করে । মন দুর্বল হয়ে গেলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে যায় । একদল বিজ্ঞানী জেনেটিক পলিজেনিক স্কোর ডাটাকে এক করে দেখতে পেলো যে ডিপ্রেশনের কারণে রক্তে শ্বেত কণিকার পরিমাণ বেড়ে যায়। হোয়াইট ব্লাড সেল বা শ্বেত কণিকা শরীরের ইমিউনিটির সাথে জড়িত । শরীরে ইনফ্ল্যামেশন কিংবা ইনফেকশন বেড়ে গেলে শ্বেত কণিকা এমন বেড়ে যায় । রক্তের এমন বায়ো মার্কারের উপস্থিতির সাথে ডিপ্রেশন জড়িয়ে প্রমাণ করে যে ডিপ্রেশন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে । করনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের উপর আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে আন্টি ডিপ্রেসিভ মেডিসিন খেলে শরীরে তার আন্টি ইনফ্লেমেটরি ইফেক্ট বেড়ে যায় । আন্টি ডিপ্রেশনের মেডিসিন দেয়ার পর দেখা গেছে রোগীর ইনফেকশন কিংবা ইনফ্ল্যামেশন জনিত সমস্যা গুলো কমতে শুরু করেছে ।তার মানে কোন ভাবে সে সব রোগীদের ডিপ্রেশন কোন ভাবে রোগীর ইমমিউনিটিকেও প্রভাবিত করছে । যখন আন্টি ডিপ্রেসিভ দিয়ে তার ডিপ্রেশনকে কমিয়ে আনা হচ্ছে, তখন তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যাচ্ছে । যদিও ব্যাপারটি পরিষ্কার নয় বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো । ডিপ্রেশন একটি মেন্টাল স্টেট, ইমিউনিটি একটি ফিজিক্যাল স্টেট । ডিপ্রেশনের কারণে ইমিউনিটি কমে যাচ্ছে, নাকি অন্য কোন কারণে ইমিউনিটি কমে যাচ্ছে বলে ডিপ্রেশন বেড়ে যাচ্ছে । তবে এটা পরিষ্কার যে, তৃতীয় কোন উপায়ে দুটো আসলে সংযুক্ত । মনের শরীরে বিষণ্ণ হলে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মনটিও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে । লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক লন্ডন, ইংল্যান্ড [email protected]
×