দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনার মূলে ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও বিস্তার পরিক্রমায় অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। শৈশব থেকে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর কিশোর ও তারুণ্যের বেড়ে ওঠা ছিল কঠিন এক সাম্প্রদায়িক পরিম-লে। ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠীর বিরূপ মনোবৃত্তির বিপরীতে বঙ্গবন্ধু কিভাবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী-অসাম্প্রদায়িক ধারণাকে লালন করতে পেরেছিলেন তার প্রকৃত বিশ্লেষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের স্মৃতিচারণে বলেন, ‘একদিনের একটি ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসঙ্গে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সঙ্গে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম, ‘ননী কি হয়েছে?’ ননী আমাকে বলল, ‘তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।’ এত সব ঘটনা অবলোকনে বঙ্গবন্ধু নিষ্ঠুর সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতাকে পরিপূর্ণ সংহার করে নিখাঁদ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী সমাজ গঠনে তাঁর ইস্পাত কঠিন ব্রতকে ঋদ্ধ করে বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছেন। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তারও মূল্যায়ন অতীব জরুরী।
বস্তুতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত, জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র-শিক্ষাদর্শন, বৈশ্বিক সম্পর্ক ইত্যাদি পর্যালোচনায় এটি বরাবরই প্রতীয়মান হয়েছে, তিনি ছিলেন অনগ্রসর বাঙালী সমাজের বিদ্যমান সকল কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, মানবাধিকারবিরোধী কার্যকলাপ, শোষণ-বঞ্চনার কঠিন অন্ধকার দূরীভূত করে বাঙালী জাতি-সত্তার ভিত্তিতে আধুনিক-গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর সততা, সত্যবাদিতা, নির্ভীক সাহসিকতা, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ছিল অতুলনীয়। এ দেশের সমগ্র জনগণ তাঁর নেতৃত্বে আস্থাশীল হয়ে অকাতরে ত্রিশ লাখ প্রাণ এবং দুই লাখ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ প্রপতন বিসর্জনে অর্জন করেছে এই স্বাধীন মাতৃভূমি। বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবন-উন্নয়ন দর্শনের মূল লক্ষ্য ছিল গরিব-দুঃখী বাঙালীর আর্থ-সামাজিক মুক্তি। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাকাল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ন্যূনতম বিচ্যুতি না ঘটিয়ে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অপরাজিত বঙ্গবন্ধু তাঁর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। জাতীয় আদর্শের মৌলিক অনুষঙ্গগুলো প্রায় প্রতিটি ভাষণেই দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত ছিল।
বঙ্গবন্ধু দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তিহীন-অযৌক্তিক-নির্মম দাঙ্গা-হাঙ্গামার নির্দয় অভিজ্ঞতায় প্রচ- কাতর ও যন্ত্রণাদগ্ধ ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এহেন অযাচিত-অবাঞ্ছিত-অনভিপ্রেত বিচ্যুতি থেকে পরিত্রাণ লাভে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক মানসে কালপরিক্রমায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিগ্রহে তিনি অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ১৯৭২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতির আদর্শের মৌলিক চারটি স্তম্ভ তথা বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চতুর্থ স্তম্ভ- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু মনুষ্যত্বের সাবলীল ও স্বাভাবিক প্রকাশে বাঙালী স্বজাত্যবোধের মূল্যায়নে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে অসাধারণ বিশ্লেষণে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ধর্ম-বর্ণ-দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের গ্রহণযোগ্য ধর্ম পালনের সৌকর্যকে উদ্ঘাটিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই।’ ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত মার্জিত-পরিশীলিত ধর্ম চর্চা বা পারস্পরিক প্রাত্যহিক বিনিময়-আদান-প্রদান-লেনদেন-শ্রদ্ধা-ভালবাসা-পুণ্য প্রীতির সঙ্গত ও সংযত প্রায়োগিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করার অনুপম ক্ষেত্রের উন্মেষ ঘটিয়েছেন।
দেশের পবিত্র সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শ প্রতিস্থাপনে বঙ্গবন্ধু শুধু বিশ্ব পরিম-লে মানবিকতার বিরল উদাহরণ প্রণয়ন করেননি, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করে তিনি অসাম্প্রদায়িক অবিনাশী চেতনার প্রচেতা হিসেবে জাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদাসীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উৎসসূত্রে প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ ছিল বাঙালীর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ। সকল ধরনের ধর্মান্ধতা পরিহারে ধার্মিকতার মানবিক-নান্দনিক-পরিশীলিত মূল্যবোধকে ধারণ করে স্বাধীনতা অর্জনের মূলমন্ত্র হিসেবে কার্যকর ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অত্যুজ্জ্বল উপমা। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের সাউথ এশিয়া সেন্টার আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অর্মত্য সেন বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, তাঁর বক্তব্য ছিল ‘সমাজের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রাখার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে মতাদর্শ তা এখনও সারা পৃথিবীর জন্য প্রাসঙ্গিক। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী স্বতন্ত্র যে ধরন ছিল বর্তমান সময়ে তার বিস্তৃত ব্যবহার রয়েছে, যা কেবল বাংলার জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় যে কোন সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরন্তর প্রতিফলন অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। ভাব-বস্তুবাদী দর্শনের আপেক্ষিক সম্মিলনে প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম ইহ ও পারলৌকিক বিশ্বাস এবং কর্মের ভিত্তিকে শক্তিমান করেছে। মূলত মানবিক মূল্যবোধের অনুরুদ্ধ বিকাশমানতা ও জনকল্যাণে নিবেদিত কর্মযজ্ঞের অনভিভূত ধারণায় ধর্ম যুগে যুগে নানা কাঠামোয় পল্লবিত হয়েছে। জাতি-বর্ণ-মানুষ-অঞ্চলভেদে প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিপালিত ঐতিহ্য-কৃষ্টি-সংস্কৃতির বর্ণীল অবগাহনে ধর্মের চিরায়ত রূপ জ্ঞাপিত। জীবনধর্মী কর্মপ্রবাহে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য, সত্য-মিথ্যার দোলাচলে অদৃশ্য-অজানা অনুভূতির মানদন্ডে পারলৌকিক ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যাশায় ধর্মভিত্তিক আচার-আচরণ কখনও সমাজকে করেছে উজ্জীবিত, কখনও অতিশয় নিষ্প্রভ। ধর্মান্ধ নয়, বিশ্বের সকল ধার্মিক ও মনুষ্যত্ব-মানবিকতায় পরিশুদ্ধ মানুষ মাত্রই কালান্তরে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে যাদের সক্রিয় অবদান-প্রাণ বিসর্জন রয়েছে, অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-কৃতজ্ঞতায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাদের স্মরণ করে থাকেন। যথার্থ অর্থে তাদের সুনাম-সম্মানকে সমাসীন করা না হলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকিত ভবিষ্যত নির্মাণ অবশ্যই কষ্টদায়ক হবে। বিপরীতে পরাজিত অন্ধকারের অশুভ শক্তিও বিজয়ের আনন্দবার্তা ও গৌরবোজ্জ্বল পটভূমিকে শুধু কলুষিত করবে না, নানা অপকৌশলে বিকৃত ইতিহাস পাঠে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সকল নষ্ট সম্ভাবনাকে ঘৃণ্য পন্থায় কাজে লাগাবে।
ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতার পার্থক্য নিরূপণে প্রত্যেক জাতি-রাষ্ট্রকে জাগরূক রাখতে হবে। অন্যথায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমাজকে অন্ধকারের গহ্বরে নিমজ্জিত করবে নিঃসন্দেহে তা বলা যায়। শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে ধার্মিক বা ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অসাম্প্রদায়িক ধারণায় ঋদ্ধ এবং ধর্মান্ধরাই সাম্প্রদায়িক কদর্য অপশক্তিকে ব্যবহার করে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে লিপ্ত থাকে। বিরোধ-বিচ্ছেদ-প্রতিহিংসা-পরশ্রীকাতরতা-লোভ-লালসার চরিতার্থে পার্থিব অর্জনকে সকল সুখবোধের অনন্য গন্তব্যের বিপরীতে ত্যাগ-তিতিক্ষা-সৌহার্দ-সম্প্রীতি-বন্ধুত্বই ছিল অপার মহিমায় ভাস্বর। নৈতিক ও আদর্শিক চিন্তা-চেতনার বন্ধন বরাবরই তৈরি করেছে সকল মানুষের জন্য নিরাপদ-গ্রহণযোগ্য-পারস্পরিক স্নেহ, ভালবাসা, শ্রদ্ধার পূর্ণোপমা বৈচিত্র্য। ধর্মের বিভাজিত সংঘর্ষ-সংঘাত পরিহার ও উন্নত মানবজীবন নির্মাণে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে কবি শেখ ফজলুল করিমের কালজয়ী ‘স্বর্গনরক’ কবিতা অনুপম ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের প্রতিচ্ছবি। ‘কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর/ মানুষেরি মাঝে স্বর্গনরক - মানুষেতে সুরাসুর।/ রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায় গো লয়,/ আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।/ প্রীতি-প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলি যবে পরস্পরে/ স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।’ উক্ত কবিতায় প্রতিটি পঙক্তি ও শব্দচয়ন নবতর ধ্যান-ধারণার লৌকিক-অলৌকিক প্রপঞ্চসমূহকে অনন্য উপমায় প্রজ্বলিত করেছে।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে কলকাতা ব্রিগেড ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর আবেগঘন ভাষণে আদর্শিক ভাবধারার চেতনাসূচী প্রকাশ করে বলেন, ‘নীতির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। আজ আমার দেশ সার্বভৌম।’ তিনি বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের পঙক্তি উপস্থাপনে বলেন, ‘নাগিনীরা চারদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস-/ বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই/ দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।’ ‘আমার বাঙালীরা প্রস্তুত আছে। নাগিনীদের আমরা চিনি।’ বঙ্গবন্ধুর উল্লেখ্য বক্তব্য এখনও যে কতটুকু প্রযোজ্য তা সমসাময়িক সমাজ পর্যবেক্ষণে অতি সহজেই অনুভূত। অশুভ-অন্ধকারের পরাজিত শক্তির সাম্প্রতিক আস্ফালন-অযৌক্তিক তান্ডব এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পরিচালিত সকল অপকৌশল দেশবাসীর দৃষ্টির গোচরীভূত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ও সচেতন জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ভয়ঙ্কর নাগ-নাগিনীর সকল চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেশবাসীর আস্থা অর্জনে নবতর অধ্যায় নির্মাণ করেছে। বঙ্গবন্ধুর অতি উচ্চমাত্রিকতার অঙ্গীকারকে এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য আদর্শ হিসেবে বাঙালী জাতিরাষ্ট্র নতুন করে অনুধাবন করতে পেরেছে। ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আল-বদর পয়দা করা বাংলার বুকে চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।’ চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধুর অমর-অক্ষয় নির্দেশনা জাতি কখনও মলিন-অকার্যকর হতে দেবে না- অনায়াসে এ প্রত্যাশটুকু ব্যক্ত করা মোটেও অমূলক নয়।
জনশ্রুতিমতে দল ও সরকারে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশকারী-বর্ণচোরা-ষড়যন্ত্রকারী-কূচক্রীমহল উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেশকে আবার অনগ্রসর সমাজে রূপান্তর করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাপাচার-কদাচার-মিথ্যাচার-প্রতারণা-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দেশ ধ্বংসের নতুন কদর্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে লিপ্ত এসব অভিশপ্ত নরপশুর উদ্দেশে দেশের বরেণ্য কবি হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ কবিতার পঙক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ/ নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ/ শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর/ ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ চলে যাবে সেই সব উপকথা : সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;- এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা/ নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।’ অবিশ্বাস করার কোন অবকাশ নেই, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় নিগূঢ় বিশ্বাসী দেশের আপামর জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের তীক্ষ চেতনাবোধে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সকল বাধাবিপত্তি নিধনে মহান স্বাধীনতার ইতিহাস-কৃষ্টি-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিসহ সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-মঙ্গল-আনন্দের সকল অনুষঙ্গ নষ্টদের কবল থেকে দখলমুক্ত করবেই।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়