ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

শোকাবহ আগস্ট ॥ আগস্টের প্রথম প্রহরের প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনা

প্রকাশিত: ২০:২৬, ২ আগস্ট ২০২১

শোকাবহ আগস্ট ॥ আগস্টের প্রথম প্রহরের প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনা

আজ দুই আগস্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে কালোকালিতে লেখা অনেক ঘটনার করুণ আখ্যানের সাক্ষী এই আগস্ট মাস। বাঙালী জাতির জনক আর স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল এই আগস্টে। এই আগস্টকে ঘিরে বরাবরই সক্রিয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশবিরোধী শক্তি। আগস্টের একুশেই সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর চালানো হয়েছিল প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলা। স্রষ্টার অপার কৃপায় দুবারই প্রাণে রক্ষা পান তিনি, সম্ভবত বাংলাদেশ আজকের এবং আগামী দিনের জায়গাটায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। মাঝে মাঝেই মনে হয় স্রষ্টা তাকে এই বিশেষ এসাইনমেন্টটা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং এত ঘাত-প্রতিঘাত আর পর্বতসম শোকের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাকে তৈরি করেছেন তার প্রয়াত পিতার অসমাপ্ত অসাধ্যকে সাধন করার জন্য। তাই বলে কিন্তু থেমে নেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। সক্রিয় তারা দীর্ঘদিন ধরেই। কখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের চেষ্টায় আগুন সন্ত্রাস তো কখনও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার চেষ্টায় নির্বাচন বয়কট আবার কখনওবা হলি আর্টিজানে রক্তের হলি খেলে তারা তাদের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে দেদার । বাংলা ভাই, সিরিজ বোমা হামলা কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরে দশ ট্রাক বোঝাই অস্ত্র খালাস আর জজ মিয়া নাটক, কত কিছুই তো এ জাতি দেখেছে চলমান শতাব্দীটির প্রথম দশকে। ২০০৯ থেকে এরা ব্যাকফুটে। একে একে উপড়ে ফেলা হয়েছে এদের একের পর এক ঘাঁটি। দেশের সীমান্ত এলাকাজুড়ে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর যে অভায়রণ্য গড়ে তোলা হয়েছিল জোট সরকারের অন্ধকার সময়ে, উচ্ছেদ করা হয়েছে সেগুলোও। তারপরও এরা থেমে গেছে বলা যাবে না। বরং বলা যায় এরা নিশ্চয়ই থেমে নেই। মাঝে মাঝেই এরা মাথাচাড়া দেয় এখানে-ওখানে আর সাম্প্রতিক সময়ের কিছু অনিবার্য বৈশ্বিক বাস্তবতা আর এই অঞ্চলের কিছু পরিবর্তিত ভ‚-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ তাদের নতুন করে শক্তি যোগাচ্ছে। কোভিড মহামারীতে গত দুটি বছরে উল্টে-পাল্টে গেছে আমাদের গৃহস্থালি থেকে ক‚টনীতি আর পরিধেয় থেকে শুরু করে জীবনাচার সবকিছুই। আমরা এখন মাস্ক পরে ঘর থেকে বের হই আর সারাদিন খুঁজে ফিরি কোভিডের সর্বশেষ আপডেট। কোভিড সামলাতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা এখন পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশে। ঘরের ভিতর কোভিড সামলাবে না পালন করবে আন্তর্জাতিক দায়িত্ব আর রক্ষা করবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাববলয়, এ দুয়ের মাঝে শ্যাম রাখি না কুল রাখি এই হিসাব কষতে বসে এখন নাভিশ্বাস উঠার জোগাড় এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রেরও। অন্যদের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই সুযোগটি নিতে চাচ্ছে আরও একবার ঐ আপাত পরাজিত দেশবিরোধী শক্তি। কোভিড মোকাবেলায় দেশে দেশে পারস্পরিক সহযোগিতার যে নতুন বাতায়ন আমরা ইদানীং দেখছি, পাশাপাশি একই ধরনের যোগাযোগ দেখা যাচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও। ভারত ও বাংলাদেশের জঙ্গীদের মধ্যে নতুন করে যোগাযোগ আর সহযোগিতার বিষয়টি সাম্প্রতিক সময় কিছু জঙ্গী গ্রেফতারের পর এখন সামনে চলে এসেছে। এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করছে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। একের পর এক আফগান জেলা এখন সরকারের হাতছাড়া হয়ে চলে যাচ্ছে তালেবানদের দখলে। এরই মাঝে আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের নতুন রেকর্ড হয়েছে, যাদের মধ্যে সিংহভাগই নারী ও শিশু। শোনা যাচ্ছে পাঁচ হাজারের বেশি বাংলাদেশী উগ্রবাদী এরই মাঝে পাড়ি জমিয়েছে আফগানিস্তানে তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য। অন্যদিকে অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা। এই মানুষগুলো শুধু যে যুগের পর যুগ উন্নয়ন আর শিক্ষাবঞ্চিত ছিল তাই নয়, এদের মাঝে উগ্র আরসা জঙ্গীদের উপস্থিতি এখন সর্বজনবিদিত। সঙ্গে আছে আরও কিছু আঞ্চলিক বাস্তবতাও। চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর যে মানবতাবিরোধী অপরাধ তার ফলে ঐ প্রদেশটির সঙ্গে সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায়নে যে চীনেও উগ্র মৌলবাদকে উসকে দেবে না তাও বলা যাচ্ছে না। সঙ্গে আছে পাকিস্তান ফ্যাক্টরও। আপাত আধুনিকমনস্ক পাকিস্তানের ক্রিকেটার টার্নড প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির সঙ্গে সেদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর যোগাযোগের বিষয়টা বরাবরই ওপেন সিক্রেট। যে কোন হিসেবেই পাকিস্তানের আইএসআই আর ক্ষমতাসীন সরকার আফগানিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে তালেবানদেরই দেখতে চাইবে। কারণ এর মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলটিকে অস্থিতিশীল করে একদিকে যেমন নিজ দেশের বালুচ, সিন্ধী ও পশতুদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ আর দমন-পীড়ন চালিয়ে যেতে পারবে, তেমনি অন্যদিকে এর ফলে তাদের হারাতে বসা ভ‚-রাজনৈতিক গুরুত্বটাও বাড়বে আর বাড়বে পশ্চিমাদের দক্ষিণা, যার একটা বড় অংশই চলে যাবে সেদেশের দুর্নীতিবাজ সেনাবহিনীর আর আমলাতন্ত্রের পকেটে। পাশাপাশি ক্রমশই বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হতে থাকা ভারতকেও চাপে রাখার যে আঞ্চলিক আগ্রহ সেখানেও তারা সহায়ক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। এ কারণেই তালেবানদের সাম্প্রতিক সাফল্যে উচ্ছ¡াসের ফোয়ারা বেছে নিয়েছে পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আফগানিস্তানের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ সম্প্রতি তার টুইট বার্তায় একাত্তরের ষোলো ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবিটি শেয়ার করে পাকিস্তানীদের মনে করে দিয়েছেন যত যাই হোক না কেন এই গ্ল্যানি থেকে কখনই মুক্ত হতে পারবে না তারা। পাশাপাশি তিনি দুঃখ করেছেন যে, বাংলাদেশের মতো এমন গৌরব আফগানিস্তানের কপালে হয়ত কখনই জুটবে না। আবার অন্যদিকে শিন জিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর যে মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে, তার ফলে ঐ প্রদেশটির সঙ্গে সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায়নে যে চীনেও উগ্র মৌলবাদকে উসকে দিবে না তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কখনও পোষ মানে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন মূল ভূখন্ডে একটা বোমাও যেখানে ফাটেনি সেখানে তাদের গর্বের টুইন টাওয়ার ধ্বসিয়ে দিয়েছিল তাদেরই তৈরি ওসামা। কাজেই মাসটা যখন আবার আগস্ট সব হিসাবই বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারতের সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার লোকের আর যাই হোক অভাব হবে না দেশে-বিদেশে যেমন অভাব হবে না তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকেরও। এবার তারা যে শুধু বাইরে থেকে আঘাত হানবে তাও সম্ভবত না। চোখ-কান খোলা রাখলেই বোঝা যায় তারা আঘাতটা করতে চায় ভেতর থেকেও। ভেতরে ভেতরে ঢুকে পড়েছে তাদের অনেক শুভানুধ্যায়ী নানা খোলসে। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়াটাও নিশ্চয়ই সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায়ন, যা বাংলাদেশের নিরবচ্ছিন্নভাবে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। এর চেয়েও বেশি দরকার বলিষ্ঠ, বুদ্ধিদীপ্ত ও দেশের স্বার্থে আপোসহীন নেতৃত্ব। আমাদের দুর্ভাগ্য আজ বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর ছায়া হয়ে আছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের আরও একটা বড় শক্তি এদেশের সিভিল সোসাইটি। সমাজের এই অংশের প্রতিনিধিত্বশীল অনেকের কারণে ‘সুশীল’ শব্দটি আমাদের অনেকের কাছেই আজ তিরস্কারের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছে যৌক্তিক কারণেই। কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আর সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মতো নাগরিক আন্দোলনগুলো কিছু ত্যাগী মানুষের কারণে এখনও টিকে আছে বলেই আমরা ভাল থাকার স্বপ্ন দেখি, যে ভাল থাকার শক্তি আর দিকনির্দেশনাটা আমাদের যোগান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ লেখাটি নিয়ে যখন ভাবছিলাম সেদিনটি ছিল বাংলাদেশের একজন মধ্যবয়স্ক তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তার পঞ্চাশতম জন্মদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে যাচ্ছিল উচ্ছ¡সিত অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা বার্তায়। সংখ্যায় তা এত বেশি যে, সেগুলো দেখারও সুযোগ তিনি কখনই পাবেন না। কেউ কোনদিন পেতেও পারে না। কাজেই যারা তাকে অভিনন্দিত করেছেন তারা যে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নয়, বরং তার প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধার জায়গাটা থেকেই তাকে শুভেচ্ছা বাণী পাঠাচ্ছেন সেটিও বলে দেয়া যায় চোখ বন্ধ করেই। তার ভাষায় তিনি একজন মধ্যবয়স্ক তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। নিজের জন্মদিনে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে দেয়া স্ট্যাটাসে তিনি তেমনটিই লিখেছেন। কিন্তু দেশের মানুষ তাকে চেনে বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের রূপকার হিসেবেই। এই করোনাকালে তিনি বাংলাদেশকে সচল রাখার নেপথ্য থেকে যে ভ‚মিকা রেখেছেন তার জন্য তার কীর্তিমান মাতামহ আর মায়ের মতো তাকেও এ জাতি স্মরণ করবে শ্রদ্ধায় এবং ভালবাসায়। এ লেখাটি যখন প্রায় শেষ করে এনেছি তখন মনে হলো, তাই তো, আমাদের তো আরেকটা শক্তির জায়গা রয়ে গেছে। যুদ্ধটা যখন এখন অনেকটাই রাজপথ ছেড়ে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, তখন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের মতো একজন আধুনিকমনস্ক, প্রযুক্তিবান্ধব সন্তানের চেয়ে এই যুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য দক্ষ আর কেইবা হতে পারেন! শোকাবহ কালো আগস্টের আরও কোন অজানা কালোর শঙ্কায় লেখার শুরুতে বুকের ভিতর যে দুরুদুরু ভাবটা ছিল এখন লেখাটার শেষ পর্যায়ে এসে তার আর লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই। বেশ বুঝতে পারছি চ্যালেঞ্জটা যত বড়ই হোক না কেন আমাদের শক্তিও অসামান্য। আমাদের পথ দেখাতে আছেন বঙ্গবন্ধু, আছেন তাঁর দুই প্রজন্ম আর সঙ্গে অগুনতির নিঃশর্ত সমর্থন। কাজেই ১৫ আর ২১-এর দুঃসহ স্মৃতি আমাদের অনন্তকাল ধরে কাঁদালেও আগস্টে নতুন করে আর কোন তারিখ কোনদিনও কালোয় লেখা হবে না। লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
×